Header Ads

বাঙালির মধ্যে যেভাবে প্রথম ইংরেজিয়ানার আবির্ভাব হয় || তৃতীয় পর্ব


এভাবে কবিতার কথায় কোন কাজই হল না, এক গুপ্ত কবি তার ক্ষুরধার ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখে তদানীন্তন নব যুবকদের ভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করতে লাগলেন--



হয় দুনিয়া  ওলট পালট 
আর কিসে ভাই ! রক্ষা হবে ? 
যত কালের যুব যেন সুবো,  
ইংরেজি কয় বাঁকা ভাবে
বলে, জৌ বাঙালি, ড্যাম, গো টু হেল, 
কাছে এলেই কোঁৎকা খাবে।... 
হয়ে হিঁদুর ছেলে, ট্যাঁসের চেলে,   
টেবিল পেতে, খানা খাবে।... 
ঢুকে ঠাকুর ঘরে, কুকুর নিয়ে, 
জুতো পায় দেখতে পাবে। …
যত দুধের শিশু, ভজে ঈশু  
ডুবে মলো ডবের(duff) টবে।  

এমনি ভাবে এই গুপ্ত কবির আরেকটা লেখাতে আমরা পাই-- 

আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো 
     ব্রত ধম্মো কত্তো সবে।
একা 'বেথুন' এসে শেষ করেছে,
  আর কি তাদের তেমন পাবে ?
যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে,
  কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে।
তখন এ বি শিখে বিবি সেজে,
  বিলাতী বোল কবেই কবে।
এখন আর কি তারা সাজি নিয়ে 
  সাঁজ সেঁজতির ব্রত গাবে ?
সব কাঁটাচামচে ধরবে শেষে, 
  পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে ?......
আছে গোটা কতক বুড়ো যদিন,
   তদিন কিছু রক্ষা পাবে। 
ও ভাই, তারা মলেই দফা রফা,
   এককালে সব ফুরিয়ে যাবে।...

অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও। এই ভয়ঙ্কর বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত হবার কথা তিনি ভাবতে লাগলেন। তিনি নিজের আত্মীয় স্বজন থেকে আসা ইংরেজিতে লেখা না পড়ে পত্র ফেরত পাঠাতে থাকলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তিনি ধর্ম, ভাষা ও দেশের প্রতি আপন ভাব জাগ্রত করার জন্য সচেষ্ট হলেন। রাজেন্দ্রলাল এ কাজে যোগ দান করলেন। তিনি জ্ঞানের প্রসারের জন্যে 'বিবিধার্থ সংগ্রহ'টির মাধ্যমে প্রচার চালাতে লাগলেন। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের নানা কথা তিনি বাংলা ভাষা বিমুখ বঙ্গবাসীদের স্মরণ করাতে চাইলেন। তখনকার সময়ে ইয়ং বেঙ্গলের সবারই কোন না কোন দিক দিয়ে ইংরেজিয়ানায় প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। এ সময় কৃষ্ণমোহন ধর্ম ত্যাগ করে ছিলেন। অবশ্য তিনি মাতৃভাষা ত্যাগ করেননি। মধুসূদন ধর্মকে গুরুত্ব দেননি, তিনিও ধর্ম ত্যাগ করে ছিলেন। এমন কি শুরুর জীবনে তিনি বাংলা ভাষাকেও বর্জন করেছিলেন। 

প্যারীচাঁদ, কিশোরীচাঁদ, রাধানাথ বাংলা ভাষার প্রতি বেশ অনীহা দেখিয়ে ছিলেন। ওঁরা প্রত্যেকেই অনেকটা ইংরেজি সভ্যতার দিকে পা বাড়িয়ে ছিলেন। শুধু মনের দিক থেকে অনেকটা সুস্থ ও স্বদেশী ভক্ত ছিলেন ভূদেব ও রাজেন্দ্র লাল। এ দলের অনুসরণকারী হিসাবে রাজনারায়ণ খানিকটা ছিলেন। ১৮৫৪ সালের দিকে প্যারীচাঁদ, রাধানাথ এঁদের মোহ ভাঙলো, তাঁরা সাধারণ সহজ সরল বাংলা ভাষায় 'মাসিক পত্রিকা' লেখা শুরু করলেন। তাঁরা তাদের কথা ও কাহিনী সাধারণ লোকদের জানাতে শুরু করলেন। প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশিত হল। এ দিকে মাইকেলের তখন ইংরেজির প্রতি আকর্ষণ কমে এসেছিল। ইংরেজিতে তিনি 'ক্যাপটিভ লেডি' উপন্যাস লিখে ইংরেজদের তাক লাগিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দেশেই ফিরে আসলেন এবং বাংলা ভাষাকে সম্মান জানালেন। কবিতায় তিনি প্রকাশ করলেন--

“নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য-রতন
অগণ্য, তা সবে আমি অবহেলা করি।”...

তারপর তিনি আবার লিখলেন--

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন,--
তা সবে, (অবোধ আমি !) অবহেলা করি.
পর-ধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
পরদেশ, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি !
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি,--
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন !

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে 
“ওরে বাছা মাতৃ কোষে রতনের রাজি, 
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি ?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যারে ফিরি ঘরে!”   
পালিলাম আজ্ঞা সুখে ! পাইলাম কালে  
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে। 

এ ভাবে ক্রমাগত মাইকেল লিখে চললেন মেঘনাদবধ  কাব্য, বীরাঙ্গনা, ব্রজাঙ্গনা, চতুর্দশপদী এবং বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ। এ ছাড়া, একেই কি বলে সভ্যতা ? তাঁর সঙ্গে এক সময় যারা পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষা ও চালচলনকে অনুসরণ করেছিলেন তাদেরকেই তিনি ফিরিয়ে আনতে লিখতে লাগলেন নানা কথা ও কাহিনী। দীনবন্ধু আরও শক্তভাবে এ কাজ করার চেষ্টা করলেন। তাঁর লেখা, সধবার একাদশী, লিখে।

মাত্র ১৮ বছরের ছেলেটি কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যী ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ‘দুরাকাঙ্ক্ষের বৃথা ভ্রমণ’, লিখলেন—

"বিংশতিতম হেমন্ত আমার দেহ শীতবাত  দ্বারা আঘাত করলে আমি স্বধর্ম ভ্রষ্ট হইয়া খ্রীষ্টের উপদিষ্ট পথ অবলম্বন করিলাম। তৎকালে আশা ছিল যে কত বিবি আমার নয়ন ভঙ্গির চাতুর্যে মোহিত হইয়া প্রাণনাথ করিতে ব্যস্ত হইবে, কত ইংরেজ আপন প্রার্থিত প্রিয়তমার অভাবে হতাশ হইয়া অশ্রুপাত ও আমার শাপ দান করিবে, এই সকল অদম্য মনোরথে  সমাকৃষ্ট হইয়াই আমার খ্রীষ্টধর্ম অবলম্বন করিতে প্রবৃত্তি হয়। যদি শ্রদ্ধার কথা জিজ্ঞাসা কর, শ্রদ্ধা আমার অন্য ধম্মে  যেমন, খ্রিস্টধর্মেও  সেইরূপ অর্থাৎ কিছুই নহে। আমি খ্রিস্টান হইয়া যে সকল আশা সিদ্ধ করিব মনে করিয়া ছিলাম তাহার একটিও সফল হইল না। কোন বিবিই প্রণয়ী ভাবে আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন না। বাঙালি বলিয়া ইংরেজরা ঘৃণা, এবং ধর্মভ্রষ্ট বলিয়া স্বজাতিরা পরিহার করিতে লাগিলেন। মিশনারীরা যে অত্যল্প মাত্রা বৃত্তি দিতেন, তাহাতে আবশ্যক ব্যয়ও নির্বাহিত হইত না। অতএব বাংলা ভাষার এক জন লেখক হইয়া বসিলাম।... বাংলা ভাষার উৎকৃষ্ট গ্রন্থ রচনা করিয়া বিখ্যাতি লাভ করিতে অভিলাষ ছিল না, অতএব চেষ্টাও হইল না। আমি বাংলার অধিবাসী, ভাষা, এমন কি সকলই অতিশয় ঘৃণা করিতাম। 

অতি পাপাচার ক্ষুদ্রদেহ কতকগুলি কৃষাণের স্বজাতীয় হইয়াছি, এই ভাবিয়াই আমার কত ক্ষোভ হইত, আবার তাহাদের দেশে তাহাদের ভাষায় কিছু আনুকূল্য করিয়া তাহাদিগের মনোরঞ্জন করিব এবং মলিনগাত্র বীভৎসাচার  নগ্নাঙ্গ পিশাচদিগের সহবাস তাহা অপেক্ষা প্রার্থনীয়, আমার তখন মনের গতি এইরূপ ছিল।"

এই ধরনের মনের গতি তখন অনেক শিক্ষিত বাঙালির ছিল। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থে এই সময়কার কথা এই ভাবে লিখেছিলেন--

"দেশের শিক্ষিত সমাজের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হইয়া উঠিতেছিল। ডিরোজিও যে স্বাধীন চিন্তার স্রোত প্রবাহিত করিয়া গিয়া ছিলেন তাহা এই সময়ে বঙ্গসমাজে পূর্ণমাত্রায় কাজ করিতে ছিল। শিক্ষিত দলের মধ্যে সুরাপানটা বড়ই প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দু কলেজের ১৬-১৭ বছর বয়সের বালকেরা সুরাপান করাকে শ্লাঘার বিষয় মনে করিত।  বঙ্গের অমর কবি মধুসূদন দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, সুপ্রসিদ্ধ রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতি এই সময়ে হিন্দু কলেজে পাঠ করিতে ছিলেন।  সে সময়কার লোকের মুখে শুনিয়াছি যে কলেজের বালকেরা গোলদীঘির মধ্যে প্রকাশ্য স্থানে বসিয়া  মাধব দত্তের বাজারের নিকটস্থ মুসলমান দোকানদারের হইতে কাবাব মাংস কিনিয়া আনিয়া দশজনে মিলিয়া আহার করিত। যে যত অসমসাহসিকতা দেখাইতে পারিত তাহার তত বাহাদুরি হইত, সেই তত সংস্কারক বলিয়া পরিগণিত হইত।"

"একদিকে যুবক বয়স্যদিগের মধ্যে এইরূপে দেশীয় রীতি বিরুদ্ধ আচরণ ওদিকে কলেজ গৃহে ডি এল রিচার্ডসন সাহেবের শেক্সপিয়ার পাঠ। এরূপ শেক্সপিয়ার পড়িতে কাহাকেও শোনা যায় নাই। তিনি শেক্সপিয়ার পড়িতে পড়িতে নিজে উন্মত্ত প্রায় হইয়া যাইতেন এবং ছাত্রগনকেও মাতাইয়া তুলিতেন।...তাঁহার মুখে শেক্সপিয়ার শুনিয়া ছাত্রগণ শেক্সপিয়ারের ন্যায় কবি নাই, ইংরেজি সাহিত্যের ন্যায় সাহিত্য নাই, এই জ্ঞানেই বর্ধিত হইত। দেশের কোন বিষয়ের প্রতি আর দৃকপাত করিত না। স্বজাতি বিদ্বেষ অনেক বালকের মনে অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠিয়া ছিল। এই ভাবাপন্ন ছাত্রগণের মধ্যে সুরাপান অবাধে চলিত। অতিরিক্ত সুরাপান বসত অনেক শিক্ষিত যুবকের শরীর একেবারে ভগ্ন হইয়া গিয়াছিল এবং অনেকে অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়া ছিল। সময় বুঝিয়া এই সময়ে সুবাগ্মি খ্রিস্টীয় প্রচারক ডফ তাঁহার মধ্য বয়সের অদম্য উদ্যমের সহিত কার্য করিতে  ছিলেন।"

আশ্চর্যের বিষয় ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং ইংরেজিয়ানার আওতায় পড়ে এই সময় হাবুডুবু খাচ্ছিলেন কিন্তু তাঁর সম্বিত ফিরতে দেরি হয়নি। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের 'ললিতা' ও 'মানসে'র লেখক দীর্ঘ ১২ বছর পরে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদনের মত যাদের ভাণ্ডারে 'বিবিধ রতন' খুঁজে পেলেন। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি একবার বাংলাদেশ ইংরেজিয়ানার বহর যাচাই করে নিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত  শিষ্য গুরুর কাব্য কবিতায় এই বিকারের পরিচয় ভালো করেই তিনি পেয়ে ছিলেন। 'আলালের ঘরের দুলাল', 'একেই কি বলে সভ্যতা ?', 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' ও 'সধবার একাদশী' তাঁকে সংকল্পে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। তিনি সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। সমরে অবতীর্ণ হতে তাঁর আরও সাত বছর সময় লাগল। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র ‘বঙ্গদর্শনে’ তিনি পাঞ্চজন্য নিনাদে  প্রথমেই ঘোষণা করলেন--

"যাহারা বাংলা ভাষার গ্রন্থ বা সাময়িক পত্র প্রচারে প্রবৃত্ত হয়েছেন তাহাদিগের বিশেষ দূরদৃষ্টি। তাহারা যত যত্ন করুন না কেন, দেশীয় কৃতবিদ্য সম্প্রদায় প্রায়ই তাহাদিগের রচনা পাঠে বিমুখ।"...

No comments