Header Ads

নেতাজী ছিলেন সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অদ্বিতীয় মহানায়ক, যিনি রূপকথাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন


২১ শে অক্টোবর, ১৯৪৩। রাত বারোটার পর সিঙ্গাপুর রেডিও মারফত আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নেতাজী সুভাষ ইঙ্গ–মার্কিন রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। শুরু হয়ে গেল মহাসংগ্রাম। এরই মাঝে চলতে লাগল সৈন্য সংগ্রহ, অর্থ ও রসদ সংগ্রহ। সিঙ্গাপুর অটোমোবাইলস–এর মালিক ব্রিজলাল জয়সওয়াল একজন বিশিষ্ট ধনী মানুষ, সিঙ্গাপুরের প্রাচীন চেট্টিয়ার মন্দির পরিষদের সভাপতি। একদিন এলেন নেতাজীর কাছে। উদ্দেশ্য ব্যবসার বিষয়ে কিছু সুবিধা আদায় করা। দেখা হতেই নেতাজী বলেন, আপনি সিঙ্গাপুরের শ্রেষ্ঠ ধনী। আজ আপনি নিজে থেকেই এসেছেন শুনে সুখী হলাম। এই তো চাই, দান আপনারা নিজে থেকে এসেই দিয়ে যাবেন। আপনিই তো এই আদর্শ স্থাপন করবেন। প্রথমটা থতমত খেয়ে ব্রিজলালজি বললেন যে, ওঁর নিজের প্রতিষ্ঠানের তরফে নয়, চেট্টিয়ার মন্দির পরিষদই আজাদ হিন্দ ফান্ডে দান করতে চায়। তবে একটি শর্ত আছে। 

নেতাজী বলেন, শর্ত তো আমি শুনব না। দান হবে নিঃশর্ত। হাজার হাজার ভারতীয় এ যুদ্ধে বুকের রক্ত দিচ্ছে— আপনার কাছে রক্ত চাইছি না আমি, চাই অর্থ। এখানে শর্ত কীসের?‌ হাত জোড় করে ব্রিজলালজি বললেন, আজ্ঞে শর্ত ঠিক নয়, আমাদের একটা আবেদন আছে। আপনি যদি অনুগ্রহ করে ট্যাঙ্ক রোডে আমাদের মন্দিরে পদধূলি দেন, তাহলে সেখানেই আমরা আপনার হাতে টাকার তোড়াটা তুলে দিয়ে ধন্য হই। নেতাজী তৎক্ষণাৎ বলেন, মন্দিরে আমার পদধূলি দেব কী?‌ ভক্তদের পদধূলি নিজেই তুলে নেব মাথায়। আপনি শুনে থাকবেন সুযোগ পেলেই আমি শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে প্রণাম করে আসি। সে সব ব্যক্তিগতভাবে করি। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসেবে কোনও সম্প্রদায়ের মন্দিরে আমার যাওয়া উচিত হবে না।



—কেন নেতাজী?‌ আপনি তো হিন্দু।

—না, সুভাষ বোস হিন্দু। নেতাজী শুধু ভারতীয়।

—তবে সুভাষ বোস হিসেবেই যাবেন।

—যাব, তবে ফৌজি পোশাকে নয়, আর তখন টাকাও নিতে পারব না আমি।

এবার একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন ব্রিজলালজি। শেষে বলেন, কিন্তু আমরা চাইছিলাম আপনি নেতাজী হিসেবেই যাবেন, সেখানে আমাদের সম্বোধন করে কিছু উপদেশও দেবেন। তা কি কিছুতেই হতে পারে না নেতাজী?‌

চোখ দুটি ধক করে জ্বলে উঠল নেতাজীর। বললেন, পারে। এক শর্তে। নেতাজী হিসেবে আমি যদি যাই, তাহলে আমার সমস্ত সহকারী যাবেন আমার সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে শিখ আছেন, খ্রিস্টান আছেন, আছেন অনেক মুসলমান। এঁদের সবাইকে যদি মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতে দেন, তবেই যেতে রাজি। কী, পারবেন?‌

একেবারে নিভে গেলেন ব্রিজলাল জয়সওয়াল। তিনি জানেন, এ অসম্ভব কথা। গুজরাটি চেট্টিয়ারদের এ মন্দিরে কোনও বিধর্মী কখনও প্রবেশ করেনি। ব্রাহ্মণ ছাড়া উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ছেড়ে কেউ কখনও অন্তরালে দাঁড়িয়ে দেবদর্শন করেনি, পূজারী ব্রাহ্মণ ছাড়া গর্ভগৃহে কেউ কখনও প্রবেশ করেনি। নেতাজী বললেন, ‘‌না হয় মন্দির কমিটির সঙ্গে কথা বলে পরে আমাকে জানাবেন।’‌ মাথা নিচু করে উঠে চলে গেলেন ব্রিজলাল জয়সওয়াল। যে সময় অর্থের ভীষণ প্রয়োজন তখন একটা ভাল অনুদান ফসকে গেল, ভাবলেন নেতাজীর কিছু ছায়াসঙ্গী। নেতাজী তাঁদের হেসে বলেছিলেন, আমার বিবেকের দাম ওই লক্ষাধিক টাকার অনুদানের চেয়েও বেশি।

আশ্চর্য, পরের দিনই আবার ফিরে এলেন ব্রিজলালজি। সঙ্গে মন্দির কমিটির আরও চার–পাঁচজন কর্মকর্তা। হাত জোড় করে ব্রিজলালজি বললেন, আমরা নিমন্ত্রণ করতে এসেছি নেতাজী ও তাঁর সহকর্মীদের। কবে আপনাদের সুবিধা হবে বলুন?‌

—আমার মুসলমান ও খ্রিস্টান বন্ধুরাও কিন্তু আমার সঙ্গে যাবেন। 

—আমরা বিবেচনা করে দেখেছি নেতাজী, যে ওঁরা মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর চোখে মুসলমানও নন খ্রিস্টানও নন। ওঁরা মায়ের সেবক। আমরা ফুল দিয়ে অর্ঘ্য দিই, ওঁরা বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের পূজা করছেন, ওঁরা আরও বড় ভক্ত।

ট্যাঙ্ক রোডের মন্দিরের দ্বার সেদিন উন্মুক্ত— যেন ভারততীর্থ। নেতাজী প্রায় একশত জন তাঁর সমরসচিব ও অনুচর–সহ মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলেন। মন্দিরদ্বারে এঁরা উপস্থিত হলে গুজরাটি মেয়ের দল উলুধ্বনি দিয়ে খই আর ফুল ছুঁড়তে থাকে। প্রত্যেককে চন্দনতিলক পরিয়ে বরণ করে নিল এক অপরূপা, ব্রিজলালজির কন্যা। নেতাজী টপবুট খুলে রেখে মন্দিরে প্রবেশ করলেন, অন্য সবাই সেভাবেই অনুসরণ করলেন। খ্রিস্টান আইয়ার, মুসলমান শাহনওয়াজ, জামান কিয়ানী আর হাবিবুর রহমান–‌সহ পাঁচজনের হাতে নৈবেদ্য ও প্রসাদী ফুল তুলে দিলেন পুরোহিত।

উদাত্তকণ্ঠে নেতাজী সেদিন বক্তৃতা দিলেন। অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে মন্দির চত্বরে। স্তব্ধ হয়ে শুনল সবাই। নেতাজী বললেন, ভারতমায়ের সন্তান আমরা, আমাদের ধর্ম আলাদা হতে পারে, কর্ম আলাদা হতে পারে, বর্ণ আলাদা হতে পারে, কিন্তু আমরা একই মায়ের সন্তান। মা আজ শৃঙ্খলিত। আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করেছি, মাকে শৃঙ্খলমুক্ত করব। তুমি হিন্দু আমি মুসলমান, তুমি শিখ আমি খ্রিস্টান, বেশ তো, কেউ কারও ধর্মে আমরা হাত দেব না। এ মরণপণ যুদ্ধে আমাদের আওয়াজ হবে ‘‌জয়হিন্দ’‌। 

ধ্বনি উঠল— হর হর মহাদেব, আল্লাহ–‌উ–‌আকবর নয়— একমাত্র আওয়াজ ‘‌জয়হিন্দ’‌। ওঁরা নেতাজীর হাতে তুলে দিলেন লক্ষ টাকার চেক।

জানি না ধর্মনিরপেক্ষতার এমন নিদর্শন আর কোনও ভারতীয় দেশনায়ক কখনও রাখতে পেরেছেন কি না। কিন্তু ভারতীয় জাতির ধর্মনিরপেক্ষতার বুনিয়াদ সেদিনই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। নেতাজী ছিলেন সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অদ্বিতীয় মহানায়ক, যিনি রূপকথাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।



তথ্যসূত্র- প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুর রচনা 

No comments