Header Ads

ব' এ বাকরখানি। একটি সুস্বাদু খাবারের স্মরণীয় ইতিহাস


শৈশব কেটেছে আজকের প্রয়াগরাজ শহরে। তখন সকালে ফেরিওয়ালাদের নানারকম আওয়াজের মধ্যে যেটা আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণ করতো তা হলো বাখরখানি । 


এক বৃদ্ধ চাচার সুরেলা কণ্ঠে এই ডাক ছোটদের কাছে সেদিন ছিল শ্যামের বাঁশি, শোনামাত্রই যার যা সঞ্চয় নিয়ে একছুটে সদর দরজায়। তারপর আর কি, চাচার কাছ থেকে মহার্ঘ ঐ জিনিসটি নিয়ে রোয়াকে বসেই সবাই মিলে খাওয়া আর বাড়িতে ঢুকে ঠাম্মার কাপড়ে হাত মোছা ! 

ও হরি, তোমরা তো আবার দেখা দূরে থাক নামই শোননি ! এটা একধরণের পরোটা যা ময়দার সাথে দুধের মালাই ও মাখন মিশিয়ে তন্দুরে সেঁকা। হালকা মিষ্টি ও মুচমুচে স্বাদ। চা থেকে মাংস সব দিয়েই খাওয়া যায় তবে ছোটদের আর সে ধৈর্য কোথায় ? সুতরাং এমনি এমনিই সই !

এপার বাংলায় না পাওয়া গেলেও পুরানো ঢাকার কিছু এলাকায় এখনো এটি তৈরী হয় তবে তার আধুনিকীকরণ হয়েছে। কিন্ত কেন এই অদ্ভুত নাম ?

ফিরে যেতে হবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে .......

আগা বাকের নামে তুর্কিস্তানের এক ভাগ্যবিড়ম্বিত বালক ক্রীতদাস হয়ে এসেছিল এ দেশে। বাংলার সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ সুদর্শন বালকটিকে কিনে নিয়েছিলেন। বালকের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব তাকে লেখাপড়া ও সামরিক বিদ্যায় সুশিক্ষিত করে তোলেন এবং তাকে পুত্র হিসেবে দত্তক নেন। ইনি প্রথমে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব পালন করেন, এরপর দীর্ঘ সময় বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তারই নামানুসারে বাকেরগঞ্জ বা পরবর্তীতে বরিশাল জেলার উৎপত্তি হয়।

এই বাকের মিঞা ভালোবেসে ছিল সুন্দরী নর্তকী খনি বেগমকে। কিন্তু আরও একজন ছিল নর্তকীর রূপে মুগ্ধ,  উজির জাহান্দার খাঁর ছেলে কোতোয়াল জয়নুল খাঁ। নর্তকীকে ঘিরে আগা বাকের ও জয়নুল খাঁর প্রেমকাহিনী ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কাছে কোথায় লাগে হালের হিন্দি সিনেমা ! নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সূত্র ধরে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাকেরকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেছিলেন। শক্তিধর বাকের বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে এলো। এরই মাঝে খনি বেগমকে অপহরণ করে দুর্গম চন্দ্রদ্বীপে পালিয়ে গিয়েছিল জয়নুল খাঁ। আগা বাকের সৈন্য সামন্ত নিয়ে চন্দ্রদ্বীপে উপস্থিত হলে জয়নুল খাঁ আর কোন উপায় না দেখে খনি বেগমকে হত্যা করে নিজেও আত্মঘাতী হয়।

প্রেমিকাকে কোনদিনই আর পেলেন না বাকের। আর এই প্রেমের স্মৃতি চিরজাগরুক রাখতে এক ধরনের রুটি তৈরি করিয়ে নাম দিয়েছিলেন বাকের খনি। ভেবেছিলেন আম জনতার মাঝে বেঁচে থাকবে তার মরহুম দয়িতা ।

সাধারণ মানুষের উচ্চারণে সেই নাম ক্রমে হয়ে গেলো ‘বাকরখানি’। একসময় হয়ে গেল নবাব আর আমীর ওমরাদের অন্দরমহলে প্রিয় খাবার !

আমরা অবশ্য এতকিছু না জেনেই সেদিন পরম তৃপ্তিতে খেয়েছিলাম। এপার বাংলার গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায় তো ঢাকার বাকরখানি খেয়ে গানই লিখে ফেললেন.....

"আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি
বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে হাজার টাকায় সোনা
হাতের কলম জনম দুঃখী তাকে বেচো না।"

আজও সুস্বাদু বাকরখানির কথা বলতে গিয়ে ওপার বাংলার মানুষ জন আগা বাকের ও খনি বেগমের অমর প্রেম কাহিনী স্মরণ করেন।

No comments