Header Ads

কেমন আছে ডিটেনশন ক্যাম্পে মৃত্যু হওয়া নিরীহ বাঙালি যুবক সুব্রত দের পরিবার?



শ্বেতা নামের বাচ্চা মেয়েটা বাবার অপেক্ষায় বসে আছে। উঠোনে বসে দিন গুণছে বাবার জন্য। বাড়িতে স্থির থাকতে পারছে না বাবাকে দেখতে পাচ্ছে না বলে। বর্ডার পুলিশ বিনা দোষে তার বাবাকে নিয়ে গেছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। হঠাৎ একদিন তার বাবা ক্যাম্পের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। বাচ্চা মেয়েটিকে সারা জীবন কাটাতে হবে পিতৃহীন হয়ে। পরিবারের একমাত্র সম্বল হলো বাবা। সে চলে যাওয়া মানে জীবন থেকে বড় কিছু হারিয়ে ফেলা। তার বাবার নাম ছিল সুব্রত দে। 


সুখী পরিবার। দিনকাল বেশ ভালোই যাচ্ছিল সুব্রত দের। ছেলে-মেয়ে ও বৌকে নিয়ে শান্তির নীড়ে অতিবাহিত হচ্ছিল তাদের প্রতিটি দিন। বেশ কিছু স্বপ্ন নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচছিল তার পরিবার। মেয়েকে পরিণত করে তুলতে তিনি তার মেয়েকে অভাব বোধ করতে দিতেন না৷ মেয়ে যা চায়তো তাই এনে দিতেন তিনি৷ মেয়ে দুধ খেতে চাইলে নিয়ে আসতেন হরলিক্স। মেয়ের জন্য নিয়ে আসতেন ভালো জামাকাপড়, চকলেট। মেয়ে নাচ ভালোবাসতো বলে তাকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন নাচের স্কুলে। ছেলের জন্যও এনে দিতেন সবকিছু। পরিবারে অভাব ছিল না এতটুকু। অথচ সেই পরিবার আজকে খানখান হয়ে গেল। কেউ কী জানতো যে একটি সুখী পরিবার এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে? কেউ জানতো না। বিনা মেঘে যেন বর্জ্রপাত নেমে এলো তাদের বাড়িতে। সুব্রত দের অকালমৃত্যু অভাব এনে দিল তার পরিবারে। 

২০০৫ সালে সুব্রত দের নামে ভোটার কার্ড জারি করা হয়। যেখানে তার নাম লেখা হয় সুবোধ দে। অবশেষে তাকে ডি ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গোয়ালপাড়া ফরেনার্স ট্রাইবুনালে তার নয় বছর ধরে কেশ চলতে থাকে। তিনি অন্যের দোকানে কাজ করতেন। সেখানে সহজে ছুটি নেওয়া যেত না কারণ তাতে অনেক টাকার ব্যাপার থাকে। কোর্টে যাওয়ার জন্য আটটি তারিখ তিনি পার করে ফেললেন৷ কোর্টে প্রচন্ড অপমানিত হলেন তিনি। তাকে হাইকোর্ট করবার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। তিনি হাইকোর্টে যাওয়ার জন্য একজন উকিল পেলেন৷ তার কাছে উকিল মশায় এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা নিলেন। তাকে কথা দিলেন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ কিছুটা স্বস্তি পেলেন সুব্রত বাবু৷ তিনি ভাবলেন এই বুঝি সমস্যা মিটলো বলে৷ কিন্তু তার উকিল সাত বছর ধরে তাকে ভুল পথে চালিত করলেন। উকিল মশাই হাইকোর্টে গিয়ে সমস্যার সমাধান করলেন না। সুব্রতবাবুর মতো একজন নিরীহ ব্যক্তির লাখ টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেলেন৷ 

২০১৮ সালের ২৬ শে মে বর্ডার পুলিশ ডি ভোটার সন্দেহে গ্রেফতার করে তাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠাঁই দিল৷ অন্ধকার ঘর যেখানে ঠিক ভাবে আলো বাতাস ঢোকে না। যেখানে মানুষকে রাখা হলে মানুষ উন্মাদ হয়ে যেতে পারে সেখানে রাখা হলো তাকে৷ তার স্ত্রী কামিনী দে প্রতিদিন তাকে দেখবার জন্য ডিটেনশন ক্যাম্পে আসতেন। ঐ ক্যাম্পের ভেতরে আসতে হলে বন্দীদের বাড়ির লোককে টাকা দিতে হয়। কামিনী দে তার স্বামীর সাথে দেখা করে তাকে ফল কিনে দিত। তার মেয়েও এলো একদিন। তার মেয়েকে তিনি প্রতিদিন দশ টাকা করে দিতেন। তার মেয়ে সেই টাকাগুলো জমিয়ে রাখতো৷ তার মেয়ে তার দেওয়া জমানো টাকাতে তার জন্য আপেল কিনে দেয়৷  
      
২৬ শে জুন রাত দশটায় হার্ট অ্যাটাকে শরীরটা তার ভেঙ্গে পড়লো। তিনি মারা গেলেন। তার বাড়িতেও পৌঁছে গেল সেই খবর। বাড়িতে নিয়ে আসা হলো তার মৃতদেহ। তিনি মারা গেছেন বিশ্বাস হলো না তার মেয়ের। প্রতিদিনের মতো সেদিনও মেয়েটি বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় বসে রইলো। তবু বাবা আর ফিরে এলোনা। কাজেই তাকে একদিন মানতেই হলো তার বাবা আর নেই। এখন আর তাকে জামাকাপড়,চকলেট কিনে দেওয়ার মতো কেউ নেই৷ তার মাকে নিতে হলো সংসারের সকল দায়িত্ব। তার মা কামিনী দে ব্যাগ সেলাই করে প্রতিটি ব্যাগপিছু আট টাকা করে উপার্জন করেন। সে অনেক কিছু খেতে চায়, তার মা তাকে খাবার চাইলেও দিতে পারেননা। মেয়ের অজান্তে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। মেয়েটির বন্ধ হয়ে গেছে নাচ শেখাও। কেবল পড়াশুনো করে আর বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এখন কাটছে তার প্রতিদিন। 

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নাগরিকত্ব হারালেন ১৯ লক্ষ বাঙালি। যাদের মধ্যে এক লক্ষ মানুষকে রাখা হয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। ঐ ডিটেনশন ক্যাম্পে আঠাশ জন বাঙালির মৃত্যু হয়। মৃতদের তালিকায় নাম ওঠে সুব্রত দেরও। সরকারের অমানবিকার বশে সুব্রত দের মতো নিরীহ মানুষদের পরিবারগুলো ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে। কোথাও মায়ের কোল শূন্য হচ্ছে তো কোথাও স্ত্রীর শাঁখা-সিঁদুর মুছে যাচ্ছে এনআরসির বীভৎসতা ও ডিটেনশন ক্যাম্পের দানবীক অত্যাচারে। মানুষের জীবনের কোন মূল্যই যেন নেই সরকারের কাছে। সুব্রত দে আজকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। যার কথা কেউ কখনো লিখবে না। তার পরিবারকে হাত বাড়ানোর জন্যও কেউ আসবে না৷ তাদের পরিবারগুলোর দুঃখের কথা কেউ বোঝেন না। যারা এনআরসিকে সমর্থন করে কেবল বাংলাদেশী তাড়াবো বলে চিৎকার করে তারা কী কখনো ফিরিয়ে দিতে পারবে এই মৃত নিরীহ মানুষগুলোর জীবন? কখনোই পারবে না তারা। তাই মানুষের জীবন নিয়ে যেন রাজনীতি না হয়। যে রাজনীতি মানুষকে এক মুহূর্তে অসহায় করে দিতে পারে, দরকার নেই সেই রাজনীতির। আজকে সকল মানুষের ভাবার সময় এসেছে। মানুষকে এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে মানুষ হাসিমুখে জীবন কাটাবে।

No comments