Header Ads

বাঙালীর মধ্যে যেভাবে প্রথম ইংরেজিয়ানার আবির্ভাব হয় || প্রথম পর্ব


লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে অনেক ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষার মধ্যে এবং বাংলা শব্দ  ইংরেজি ভাষার মধ্যে জুড়ে গেছে। আমরা বাংলা ভাষা বলার বা লেখার সময় তার মধ্যে ইংরেজি জুড়ে দিই। আর  এমনটা দেখতে শুনতে আমরা বেশ অভ্যস্ত। একটা সময় ছিল ইংরেজরা টেনে টেনে বাংলা বলতো, আর বাঙালিরা কাটা কাটা ইংরেজি। ইংরেজ বাংলা তথা ভারতে দীর্ঘকাল প্রায় ২০০ বছরের মত রাজত্ব করে গেছে। তাদের ভাষার সঙ্গে আমাদের ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে, অনেক ইংরেজী শব্দকে আমরা সরাসরি বাংলা করে নিয়েছি। আবার ইংরেজি সাহিত্যে অনেক বাংলা ভাষার সংযোজন ঘটেছে। 


ব্রিটিশ সময় কাল থেকে ইংরেজ কর্তৃপক্ষদের আচার বিচার যেমন বাঙালীর মাঝে ঢুকে গিয়েছিল ঠিক তেমনি ইংরেজদের আচার ব্যবহারের মাঝেও ভারতীয় অনুকরণ প্রবেশ করে ছিল।

আদব কায়দার দিকে নজর রাখলেও দেখা যাবে যে অল্প বয়সের মেয়েদের নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমার নাম কুমারী অমুক। সুশিক্ষিত লোকরাও বিনা দ্বিধায় বলেন, মিস্টার বাসু যার উচ্চারণ থাকে অনেকটা এই ধরনের--বাসিউ। মেয়েদের নাম ডলি ডেইজী ইভা লিলি শেলী ইত্যাদি। এই নামগুলি যখন ইংরাজিতে লেখা হয় sheila। এমনি ভাবে আবার ইংরেজিতে অনিল হয়ে যায় oneil, বরেন হয় Warren। এরা কেউ স্বনামে ধন্য হতে চান না। নামকে বিকৃত করে ইংরেজি নাম একটা সময় বেশ প্রচলন ছিল। অবশ্য এখনও দেখা যায় যে এই ধরণের নাম ধন্য হয়ে আজ অনেক বাঙালী বিদেশে এবং স্বদেশে বিরাজমান আছেন। নাম বিকৃত করে ইংরেজের নকল করা তদানীন্তন সভ্যতার একটা অঙ্গ ছিল বলা যায়। মিস-এর বদলে কুমারী লিখলে কি লাভ হয় ? একটা সময়ে যখন কুমারী সধবা বিধবা সবাই শ্রীমতী ছিলেন। বর্তমানে কুমারীকে বিশেষ করে দেখাবার কি আছে ! এ ভাবে কিন্তু পুরুষদের কৌমার্য শোষণ করা হয় নি ! 

প্রায় ২০০ বছর ইংরেজ রাজত্বের সংস্রবে এসে বাঙালীরা নিজেদের বাঙালিত্ব ভুলে গিয়ে বারবার ইংরেজিয়ানা গ্রহণ করতে চেয়েছে। ইংরেজি বলার লেখার প্রবল চেষ্টা আমাদের বাংলা ভাষাকে অনেকাংশে খর্ব করেছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে বাঙালিকে দোষ দেওয়া যাবে না। ইংরেজি না জানলে তখন অফিস-আদালতের চাকরি করা ছিল অসম্ভব প্রায়। এ কারণে সাধারণ লোক ইংরেজি ব্যবহার করতে বাধ্য হত। সে সময়টা যে রাজত্ব ছিল ইংরেজদের হাতে।

শুরুতে আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ নাম ছিল। লাট সাহেবের অনুগ্রহ লাভের জন্য তার নামকরণ হল কারমাইকেল কলেজ। তারপর আবার প্রতিষ্ঠানকে স্মরণ করে আর. জি. কর কলেজ করা হল। একটি সমিতির বিজ্ঞাপনের মাঝে মাঝে আমরা দেখতে পেতাম--better bengal society বাঙালীর বা সে সময় বাংলার উন্নতি করাই যদি উদ্দেশ্য ছিল তবে এ ধরণের ইংরেজি নাম বা বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনটাই বা ছিল কোথায় ?

এ ব্যাপারে সামান্য ঐতিহাসিক দিকটা আলোচনা করলে দেখা যাবে আমাদের চরিত্রগত বা ধাতুর ঋণ যে কারণেই হোক সেই দুই শত বৎসরের ইংরেজ সংশ্রবের মধ্যে বহুবার আমরা আত্মবিস্মৃত হয়ে রাতারাতি ইংরেজ হবার চেষ্টা করে গেছি। এ জায়গায় আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে, আমাদের বাঙালী জীবনে বড় বড় মনীষী আবির্ভূত হয়েছেন। সেই সময়টা অনেক চিন্তা নায়কদের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের উপদেশ বক্তৃতা, তাদের কার্যকলাপ, তাদের ভাষা ভাব ভাবনা, এসব কিছুর দ্বারা আমাদের দেশ বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এ ভাবে স্বদেশী ভাবের উদয় মাঝে মাঝেই ঘটে যাচ্ছিল।

বাঙালির ইংরেজিয়ানার ইতিহাসের এক জায়গায় দেখা যায়, কেশব চন্দ্র সেনের পিতামহ দেওয়ান রামকমল সেন তাঁর ইংরেজি বাংলা অভিধানে লিখেছেন-- '১৬২০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি ইংরেজরা প্রথম তদানীন্তন বাংলাদেশে আসে। তাদের গোবিন্দপুর ও সুতানুটিতে বাসকালে বাঙালীরা কেউ তাদের কাছ ঘেঁষতে সাহস করত না, কারণ ইংরেজদের কথাবার্তা তারা বুঝতে পারত না। তখন শুধুমাত্র ইঙ্গিত অঙ্গভঙ্গির দ্বারা কিছুটা ব্যবসা-বাণিজ্য চলত।' 

১৬৮০ সালে কোম্পানির গুদাম ঘর হিসাবে পুরনো কেল্লা নির্মিত হয়। কলকাতার অনেক বাঙালী সেখানে কর্মচারী রূপে নিযুক্ত হয়ে ছিলেন। এর কয়েক বছর আগে এক ইংরেজদের যুদ্ধ জাহাজ বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে এসে নোঙর ফেলে। বসাক ও শেঠরা তখন কলকাতার সম্ভ্রান্ত ঘর। তারা তন্তুবায় ছিল। ইংরেজ সওদাগরদের সঙ্গে তাদের অনেক দিনের পরিচয় ছিল। ইংরেজদের সঙ্গে তাদের কাটা কাপড়ের কারবার ছিল। তা ছাড়া তারা প্রচুর ‘গড়া’ কাপড় প্রস্তুত করতেন এবং কোম্পানিকে বিক্রি করতেন।

একবার জাহাজের ক্যাপ্টেন তাদের কাছে একজন দোভাষ, মানে দোভাষী পাঠাবার জন্য সংবাদ দিলেন। মাদ্রাজে তখন সাহেবরা দোভাষীর দ্বারা ভাষা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক উপকৃত হয়ে ছিলেন। সে সময় বাঙালী ব্যবসায়ীদের কাছে অনেক ধোপা থাকত। জাহাজের ক্যাপ্টেনের দোভাষী পাঠানোর অনুরোধে বসাক ও শেঠ পরিবারের লোকরা বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না যে সাহেব কি চান। শেষে সমস্ত বসাক ও শেঠদের পরিবার মিলে এক সভা বসালেন। অনেক আলোচনার পর সেই সভার এক জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, জাহাজের ক্যাপ্টেনের নিশ্চয়ই একজন ধোবার প্রয়োজন। জামা কাপড় ধোলাইয়ের প্রয়োজনে তারা আসলে ধোপা চেয়েছেন। বিচার বিমর্শ করে এ ব্যাপারে এক জনকে পাঠানো হবে বলে ঠিক করা হল কিন্তু সে ভয়ে ইংরেজের জাহাজে যেতেই চাইল না। তার পরিবারে কান্নাকাটি পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত যেন উত্তর মেরুতে অভিযানে যাচ্ছে এমনি ভাবে সে ধোপা অনেক কষ্টে যেতে রাজী হল।

বাঙালি হিন্দুদের তখন রীতি রেওয়াজ ছিল, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে হলে সঙ্গে নজর বা উপহার নিয়ে যেতে হত। পাকা কলা ও মিষ্টি সঙ্গে নেওয়া হত। শেষ পর্যন্ত সেই দুঃসাহসী ধোপা নিজের সঙ্গে পাকা কলার এক কাঁদি ও মিষ্টির এক হাঁড়ি নিয়ে হাজির হল জাহাজের ধার পর্যন্ত। তার আসার কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে একটি তোপধ্বনির দিয়ে জাহাজে তাকে স্বাগত সম্বর্ধনা দেওয়া হল। জাহাজের এক ইংরেজ তাকে সম্বোধন করে উঠল—welcome, welcome !

ধোপা তার কিছু দিনের রপ্ত করা ইংরেজী বলে উঠল—সের, ঠেক ইউ (sir, thank you !)--তারপর ইংরেজরা তাকে ব্যাগ ভর্তি সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান উপঢৌকন সে দিনের মত বিদায় দিয়েছিল। সবকিছু ভাল ভাবে হওয়ার পর এই ধোপাটি প্রথম দেশীয় বা বাঙালী কর্মচারী রূপে বহাল হয়েছিল। পরে দীর্ঘকাল কাজ করার ফলে ইংরেজি ভাষায় সে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। কলকাতায় দেশীয় লোকদের মধ্যে এই ব্যক্তি ছিল সর্ব প্রথম ইংরেজি পণ্ডিত।

১৭৭৪ সালে কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। সে সময় বিশেষ করে বাঙ্গালীর ইংরেজি জ্ঞান কাম্য ও আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। ইতিহাস অনুসরণ করলে দেখা যায় যে সে সময় রামরাম নামক এক ব্রাহ্মণ ব্যক্তি ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। কি ভাবে কেমন করে তিনি ইংরেজি শিখে ছিলেন তা অবশ্য জানা যায়নি। তিনি নিজে অনেক বাবুকে ইংরেজি শিখিয়ে ছিলেন। তারমধ্যে রামনারায়ণ মিত্রের নাম উল্লেখযোগ্য। রামনারায়ণ সুপ্রিম কোর্টের কেরানি ছিলেন। পরে তিনি বিখ্যাত উকিল হয়ে ছিলেন। কারণ তিনি ইংরেজিতে দরখাস্ত মুসাবিদা করতে পারতেন। সর্বনাশা ইংরেজি আইনের প্রণালী ও ব্যবহার রপ্ত করে নিয়ে ছিলেন রামনারায়ণ। এই দৌড়ে তিনি নিজের ভাগ্য ফিরিয়ে নিতে পেরেছিলেন। তখনকার অনেক ধনী পরিবারের মামলা-মোকদ্দমা তিনি চালাতেন এবং প্রচুর পয়সার অধিকারী হয়ে ছিলেন। তিনি আদালতের মামলা মোকদ্দমার ব্যাপারে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পরে তিনি একটি স্কুল খুলে যথেষ্ট পয়সা উপার্জন করেন। সে স্কুলে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এ সময়ের কিছু পূর্বেই হবে, আনন্দীরামদাস নামের আর এক ব্যক্তি এই কাজে লেগে ছিলেন, তিনি রামনারায়ণ থেকেও বেশী ইংরেজি শব্দ জানতেন। তার নিজস্ব একটি শব্দকোষ বা শব্দ সংগ্রহ ছিল। এটিকে সে সময় ইংরেজি জ্ঞানের রত্নভাণ্ডার বলা হত। অনেক বাঙালী যুবক ঘণ্টার পর ঘণ্টা তদারকি করে তার কাছ থেকে ইংরেজি বিদ্যাশিক্ষা করত। এই ধর্মপ্রাণ দানবীর প্রত্যেক দিন পাঁচটি শব্দ প্রতি শিক্ষার্থীকে দান করতেন। ওই সময় বাংলা অক্ষর ব্যবহার করেই ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া হত--যেমন-- লাড(Lord) ঈশ্বর, গাড(God) ঈশ্বর,কম(Come) আইশ,গো(Go) যাও, গোইন(Going) যাইতেছি ...ইত্যাদি।


No comments