Header Ads

বাংলার উদ্যোগপতিদের পথপ্রদর্শক কিংবদন্তি বাঙালি আলামোহন দাশ


একটি অপবাদ প্রায়শই শোনা যায় যে বাঙালি নাকি ব্যবসা করতে পারে না। অথচ এই বাংলার মাটি থেকেই উঠে এসেছে হেমেন্দ্রমোহন বসু, মতিলাল শীল, বটকৃষ্ণ পাল, গৌড়মোহন দত্ত ইত্যাদির মতো দিক্‌পাল ব্যবসায়ী বা বলা ভালো উদ্যোগপতিরা। এমনই এক উদ্যোগপতির জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হবে এই প্রবন্ধে। সেই কিংবদন্তি বাঙালি উদ্যোগপতির নাম আলামোহন দাশ। এঁনাকে বলা হয় 'বাংলার উদ্যোগপতিদের পথিকৃৎ বা পথপ্রদর্শক'।


জন্ম ও ছেলেবেলা- আলামোহন দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৫ সালে বা ১৩০১ বঙ্গাব্দে হাওড়া জেলার খিলা-বরুইপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল গোপীমোহন দাশ। আলামোহনের জন্মগত নাম ছিল সুরেন্দ্র মোহন দাশ। তিনি এক নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায় যে তিনি ছেলেবেলায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাঁকে গ্রামের এক কবিরাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কবিরাজ তাঁকে দেখে মৃত বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু শ্মশানে যখন তাঁকে দাহ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তখন দেখা যায় যে তিনি জীবিতই আছেন। বাঙালি জাতিকে ব্যবসায় সাবলম্বী করার জন্যই হয়ত ভগবান তাঁকে ফিরিয়ে দেন।যাইহোক, প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসার জন্য তাঁকে ঠাকুমাসহ সবাই 'এলা ছেলে' বলে ডাকত। এলা মানে 'নির্জীব'। এই 'এলা ছেলে' থেকেই তাঁর নাম হয় আলামোহন। তখনকার দিনে বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে নানা সংক্রামক রোগে অনেকেই মারা যেতেন। আলামোহনের পরিবারেরও অনেকেই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে  মারা যান। তাঁর বাবাও সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন তখন তাঁর মা স্বামীর চিকিৎসা করার অর্থ সংগ্রহের জন্যে জমি, ঘটি-বাটি ও বাড়ির নানা আসবাব বেচে দিয়েছিলেন। গোপীমোহন সুস্থ হয়ে এলেও এক করুন দারিদ্রতার সাগরে তাঁর পরিবার ডুবে যায়। বলাই যায় যে, দারিদ্রতার মধ্যে আলামোহনের ছেলেবেলা কেটেছে। আর্থিক অনটনের জন্যে প্রাথমিক শিক্ষার পর তাঁর আর লেখাপড়া এগোয়নি। একজনের অল্পবিদ্যা থাকলেও কি করে সফল উদ্যোগপতি হয়ে ওঠেন তা আমাদের রীতিমতো বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

শিল্পোদ্যগী ও সমাজসেবক- গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে পড়ার পর ১৪ কি ১৫ বছর বয়সে মুড়ি বিক্রি করে আলামোহন তাঁর ব্যবসায়ী জীবন শুরু করেন। এরপরে কলকাতা শহরে মজুর, সেলসম্যান ইত্যাদির কাজ করেন। তারপর নিজেই খাদ্য শস্যের দোকান তৈরি করেন। প্রথমজীবনে তিনি ছোট ব্যবসা করলেও পরে বৃহৎ শিল্পের দিকে ঝোঁকেন। আলামোহন ছিলেন একেবারে স্বদেশী মানুষ। লেখাপড়া বিশেষ না জানলেও নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় তিনি বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পাঠ করেন। এঁদের লেখাই তাঁর মনের পূর্ণতা ঘটায়। স্বদেশি আন্দোলনের অঙ্গীকার হয়ে তিনি ক্রমে ওজন-যন্ত্রপাতি নির্মাণ করে ও মেশিনারির দোকান ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। বাঙালিদের মতো ব্যবসায় তিনি বিমুখ ছিলেন না। হাওড়ায় কেমিক্যাল ফ্যাক্টরীর নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রথম শিল্পে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। স্বদেশী যুগে ১৯৩০ সালে কয়েকজন বাঙালি শুভাকাঙ্খীদের সাহায্যে তিনি তিনি 'ইন্ডিয়া মেশিনারি কোম্পানি' স্থাপন করেন। এই কারখানায় মূলত লেদ, ওজন যন্ত্র, ছাপার যন্ত্র, পোশাক উৎপাদন করার যন্ত্র তৈরী করা হত। 


তৎকালীন সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী এই কারখানা থেকেই অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের দ্রব্যাদি  উৎপাদন করা হত। এই কারখানা থেকেই প্রথম শ্রেণির যন্ত্রাদি নির্মাণ করা হত। ১৯৩৭ সালে তিনি 'ভারত জুট মিল' স্থাপন করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে, এই জুট মিল উদ্বোধন করেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় যিনি নিজেই একজন কিংবদন্তি বাঙালি বিজ্ঞানী ও উদ্যোগপতি। এরপর ১৯৪১ ও ১৯৪২ সালে আলামোহন যথাক্রমে 'হাওড়া ইনস্যুরেন্স কোম্পানী' ও 'এশিয়া ড্রাগ কোম্পানী' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪২ সালে তিনি তাঁর পদবিতেই 'দাস সুগার কোম্পানী'ও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এইসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি 'দ্য ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানী (১৯৪৫ সালে)', 'আরতি কটন মিল (১৯৪৬ সালে)'ও প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও নানা ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। এইসব কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নিজের আর্থিক সচ্ছলতা ও লাভের মুখই শুধু দেখেননি বরং বাংলার প্রচুর যুবকদের চাকরী ও অর্থলাভও দেখিয়েছিলেন। এ যেন নিজের ও অপরের মঙ্গলসাধন করার মতো।

তিনি ব্যাঙ্কের সাথেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর নিজস্ব বেসরকারী ব্যাঙ্কের ব্যবসাও ছিল এবং সারা বাংলায় যার ১২ থেকে ১৪ টি শাখা ছিল। এছাড়াও তিনি স্কুল ও মন্দির নির্মান করা, পুকুর খনন করা ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজও করে গেছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাঁর নিজস্ব গ্রামে পিতা গোপী মোহনের নামে ২রা জানুয়ারি,১৯৪৮ সালে 'খিলা গোপি মোহন শিক্ষা সদন বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করা। তিনি নিজের পদবিতেই শিল্পশহর 'দাশনগর' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

রাজনীতিতে- এরকম একজন উদ্যোগপতি ও সমাজ সেবকের রাজনীতিতে আসাই উচিৎ বলে সাধারণ মানুষও মনে করেছিলেন। আর তাই তো, ১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রথম নির্বাচনে 'আমতা বিধানসভা কেন্দ্র' থেকে তিনি নির্দল প্রাথী হিসাবে জয়লাভ করেছিলেন। কোনো দলে না গিয়েও সক্রিয় রাজনীতি করা যায় এই নমুনাও তিনি রেখে গেছেন।

মৃত্যু ও এক বিস্ময়- ১৯৬৯ সালে অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর আগে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। স্বদেশী যুগে বাঙালিকে সাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মতে বাঙালি অন্যের অধীনে চাকরী না করে ব্যবসা করুক। এ যেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতের সাথে মিল হওয়া। জানা যায়, তিনি সর্বদা বাঙালি কর্মীদের কারখানায় নিয়োগ করতেন। নিজের উদ্যোগে দেশজ পদার্থ উৎপাদন ও দেশের মানুষের রুটি রোজগারের ব্যবস্থাও করেছিলেন। 

তাঁর কর্মের পাশাপাশি তিনি জাতির প্রতি রেখে গেছেন এক পরম বিস্ময় আর তা হল একজন ডিগ্রিধারী না হয়েও কি করে জাতিকে পথ দেখাতে পারেন? একজন অল্প শিক্ষিত হয়েও কি করে হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল উদ্যোগপতি?

প্রতিবেদন- ইন্দ্রনীল মজুমদার


No comments