Header Ads

আধুনিক বাংলা কাব্যে এক নতুন আবহের সৃষ্টি করেন পল্লীকবি জসীমউদ্দিন


"রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও, বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও"। কবিতাটি নিশ্চয় মনে আছে৷ থাকবারই কথা। এমন কোনো বাঙালি নেই যারা শৈশবে এই কবিতাটি পড়েননি। 'রাখাল ছেলে' কবিতায় লুকিয়ে আছে একটা আবেগ। এ কবিতার সাথে জড়িয়ে আছে অজস্র স্মৃতি। যার হাতের ছোঁয়ায় লেখা হয়েছিল এই কবিতা তিনি পল্লীকবি জসীমউদ্দিন। ইংরেজি বছরের প্রথম দিন বাঙালির শুরু হয় কবি জসীমউদ্দিনকে স্মরণ করে। কারণ পয়লা জানুয়ারি দিনটি ইংরেজি নববর্ষের পাশাপাশি জসীমউদ্দিনের জন্মবার্ষিকী। 


বাংলার আবহমান জীবনধারাকে তিনি ব্যক্ত করতেন কবিতার মাঝে। গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি, নদ-নদী, সমাজ, ঐতিহ্য মিশে গেছে তাঁর কবিতায়। বাংলার কৃষ্টিকে অতীব যত্ন সহকারে লেখার মধ্যে তিনি বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কবিতা পড়লে কেমন যেন একটা মায়া পড়ে যায় বাংলা মায়ের প্রতি। তাঁর কবিতা পাঠককে অনেক বেশি ভাবায়। অদ্ভুত মুগ্ধতা রয়েছে তাঁর লেখা কবিতার ভাবরসে। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যে সৃষ্টি করেন এক নতুন আবহ।

শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা থেকে নিজেকে সরিয়ে গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবনায় তিনি কবিতার চিত্রপটে পল্লীসমাজকে তুলে ধরতেন। কেবল পল্লীসমাজই নয় মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়েও তিনি কবিতা লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ কবর কবিতার কথাই যদি বলা হয়। তাঁর কবিতার শুরু থেকে শেষে প্রতিটি উদ্ধৃতিতেই রয়েছে কাব্যিক ছন্দের সমাহার। তিনি রবীন্দ্র যুগের কবি হলেও রবীন্দ্র ভাবনার প্রতিফলন প্রকাশ পায়নি তাঁর কবিতায়। যার সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো তিনি বিশ্বাস করতেন স্বতন্ত্রতায়। তাই জসীমউদ্দিন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন "জসীমউদ্দিনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নূতন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে।"  
   
জসীমউদ্দিনের কবিতায় রবীন্দ্র ভাবনা না থাকলেও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলেছেন 'মহাকবি'। এমনকি মুষ্টিমেয় মানুষের কবি হিসেবেও অভিহিত করেছেন। রবীন্দ্র চর্চার ব্যাপারেও তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য রচনার পথিকৃৎ মনে করতেন। 

পল্লীকবি জসীমউদ্দিন লিখে গেছেন অসংখ্য কাব্য, বেশ কিছু নাটক ও আত্মকথা। কাব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'রাখালী', 'নকশী কাঁথার মাঠ', 'বালুচর', 'ধানখেত', 'সোজন বাদিয়ার ঘাট', 'হাসু', 'রূপবতি', 'মাটির কান্না', 'এক পয়সার বাঁশী', 'সকিনা', 'সুচয়নী', 'ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে', 'মা যে জননী কান্দে', 'হলুদ বরণী', 'জলে লেখন' প্রভৃতি। নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'পদ্মাপার', 'বেদের মেয়ে', 'মধুমালা', 'পল্লীবধূ', 'গ্রামের মেয়ে', 'ওগো পুষ্পধনু', 'আসমান সিংহ' প্রভৃতি। আত্মকথার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'যাদের দেখেছি', 'ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়', 'জীবন কথা', 'স্মৃতিপট', 'স্মরণের সরণী বাহি' প্রভৃতি। তিনি কবিতা, নাটক, আত্মকথা ছাড়াও 'বোবা কাহিনী' নামের একটি উপন্যাস ও কিছু সংখ্যক গান এবং ভ্রমণকাহিনী লিখেন৷  
   
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ১ লা জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতবর্ষের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ফরিদপুরে। যা বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত। তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর লেখনীতে। তাঁর কবিতা গ্রাম-বাংলার কথা বলে। গ্রামের রাখাল বালক নক্সী কাঁথার মাঠে আজও হেঁটে গেলে মনে পড়ে যায় জসীমউদ্দিনের কবিতার কথা। পল্লীসমাজে চোখ রাখলেও তাঁর কথাই সবার প্রথমে ভেসে আসে। তাঁর কবিতার রসাত্মবোধ ঠিক এতোটাই।  বাংলাদেশের গোবিন্দপুর অর্থাৎ জসীমউদ্দিনের পূর্ব পৈতৃক ভিটায় প্রতি বছর পয়লা জানুয়ারি তাঁর জন্মদিনকে স্মরণ করে 'জসীম মেলা' নামের একটি পাক্ষিক উৎসব উদযাপিত হয়।

No comments