Header Ads

বাংলার প্রাচীন পটশিল্পকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নয়াগ্রামের মহিলা স্বর্ণ চিত্রকর


পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা ব্লকের নয়া গ্রাম। স্থানীয়দের কাছে যে গ্রাম পটুয়াদের গ্রাম বলে পরিচিত। প্রায় একশো জনেরও বেশি পটুয়ার বসবাস এই গ্রামে। নয়াগ্রামের পোটো পাড়ার পটুয়া রমণী কুলের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন স্বর্ণ চিত্রকর। যিনি দারিদ্র্যতার সাথে লড়াই করে নিজের শিল্পসত্ত্বা বজায় রেখে একজন পট শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন৷ শৈলীগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সঙ্গীত চর্চা তাঁকে পট গবেষকদের চোখে অন্য ভাবে চিনিয়ে দেয়। তাঁর কাছে শিল্পই হলো জেহাদ৷ চল্লিশ বছর বয়সের এই নারী শিল্পকর্ম নিয়ে বছরে দুই থেকে তিনবার বিদেশ পাড়ি দেন। বছরভর পটশিল্প নিয়ে তাঁর নিদারুণ ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায়। প্রাকৃতিক উপায়ে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করে তিনি পট নির্মাণ করেন। শিম পাতা, গাছের পাতা, কাঁচা হলুদ, বেলের আঠা, লণ্ঠনের কালি প্রভৃতি তিনি রঙ হিসেবে কাজে লাগান। তিনি পটে সাধারণত রামায়ণ, মহাভারত ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের ছবি আঁকেন ৷ 

          
তাঁর পরিবারে পট আঁকার প্রচলন থাকলেও মেয়েদের জন্য পট আঁকা নিষিদ্ধ ছিল৷ তাঁর বাবা যখন পট আঁকতেন, তখন তিনি তা বসে বসে দেখতেন৷ কখনও কখনও পট আঁকার সমস্ত সরঞ্জামের তিনি ব্যবস্থা করে তাঁর বাবাকে সাহায্য করতেন। মাঝে মধ্যে পটের কিছু নকশাও তিনি বানাতেন। কিন্তু পটের আসল কাজে তাঁর বাবা তাঁকে হাত দিতে মানা করতেন। সেই সময়টাতে তিনি চিন্তা করতেন "আমি কবে নিজের থেকে পট বানাবো। আমার খুব শখ পট বানানোর।"  
   
একদিন তাঁর বাবা পটের কাজ ছেড়ে অন্য কাজে বেরিয়েছিলেন। সেই সুযোগে তিনি একটি পটে ছবি এঁকে ফেলেন৷ বাবা বাড়িতে ফিরে আসার পর তাঁর কাজ দেখে কিছুটা বকাবকি করেন তাঁকে। তবে বকাবকি করলেও মনে মনে মেয়ের জন্য গর্ববোধ করেন। এরপর নিয়ম করে তিনি নিজেকে পটের কাজে নিয়োজিত করতে লাগলেন৷ অভাবের সংসারে তাঁর জন্ম হওয়ার জন্য তিনি স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগটুকুও পাননি ৷ 

তিনি সবে দশ বছর বয়সে পা দিয়েছেন আর ঐ বছরেই বন্যাতে তাদের ঘরবাড়ি সব ভেঙে খানখান হয়ে যায়। স্বভাবতই দেশের বাড়ি ছেড়ে তাঁর বাবা-মা ভাইয়েরা সবাই মিলে মামাবাড়ি চলে যান। তাঁরা ছিলেন ছয় ভাই ও এক বোন৷ অভাব যেখানে নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়াত। তাঁর মামাবাড়িতে থাকার সময়কালে তাঁর বাবা প্রতিমা বানানোর কাজ আরম্ভ করলেন ও তাঁর ভাইয়েরা পটের কাজ করতে লাগলেন। খাবারের জন্য তাঁর পরিবার প্রচন্ড দুর্দিনের মধ্যে দিন কাটাতে লাগলো। তিনি খাবারের জন্য সারাদিন মাঠে জমির কোণায় কোণায় জমে থাকা জলভর্তি গর্তে খোঁচা দিয়ে চিংড়ি মাছ, শামুক, কাঁকড়া ধরে বাড়ি নিয়ে যেতেন। তাঁর মা সেগুলো সেদ্ধ করে বা কখনো পুড়িয়ে দিতেন। সেই খাবার খেয়ে দীর্ঘ দুই মাস কাটাতে হয় তাদের। 

চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়৷ শ্বশুর বাড়িতে তাঁর ওপর শুরু হয় শারীরিক অত্যাচার। জোর করে তাঁর ছবি আঁকা, গান গাওয়া সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বামী সারাদিন ভিক্ষে করে বাড়ি ফিরে আসতো। সারাদিনে একবারও উনুনে ভাতের হাঁড়িটুকু পর্যন্ত চড়তো না। বিয়ের পর তাঁর একটি মেয়ে হয়। তিনি শ্বশুরবাড়ির অকথ্য অত্যাচার সইতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতে নিজের মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসেন। তারপর পটশিল্পকে পেশা করে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য নেমে পড়েন৷ পরবর্তীকালে তাঁর স্বামীর সঙ্গে বোঝাপড়া হওয়া সত্বেও তিনি ফিরে যাননি শ্বশুরবাড়িতে৷ নয়াগ্রামেই স্বামীর সঙ্গে ঘর বেঁধে নতুন জীবন তিনি শুরু করলেন ৷ 

তাঁর পটের কাজ বেশ সাড়া জাগাতে লাগলো দেশ থেকে শুরু করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগলো তাঁর পটগুলি। স্বতন্ত্র শিল্পসত্বার তিনি গভীরভাবে ছাপ রাখেন৷ তাদের গুরু গৌরি চিত্রকর ও দুখুশ্যাম চিত্রকরই প্রথা ভেঙ্গে মেয়েদের আঁকার প্রচলন শুরু করেন৷ কিছুদিনের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয় পটচিত্র শিল্পীদের সঙ্গে একটি প্রজেক্টের জন্য গ্রামে আসে৷ মাসের পর মাস পটচিত্র শিল্পীদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার শিল্পী-অধ্যাপকরা কাজ করেন। প্রজেক্টের শেষ পর্যায়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ছবি আঁকার সুযোগ পেলেন। তিনি মেলবোর্নে পাড়ি দিলেন। তিনি গ্রামের মহিলা অস্ট্রেলিয়ার ভাষা বোঝেন না। তার ওপর গগনচুম্বী অট্টালিকা পাথরে মোড়া বিশাল শহরের সৌন্দর্য তাঁর চোখ ঝলসে দিত৷ এই শহরে কাজ করার মধ্য দিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস সহস্র গুণ বেড়ে যায়।
 
বর্তমানে তাঁর বয়স চলিশ বছর৷ পটচিত্র শিপের দক্ষতার জন্য রাজ্য ও জেলাস্তরে তিনি অর্জন করেছেন অনেক পুরস্কার। তিনি আমেরিকা, প্যারিস, জার্মানি, ইতালি, সুইডেনে বহুবার গেছেন কর্মসূত্রে। দেশ-বিদেশ থেকে পটশিল্পের জন্য অজস্রবার সম্মান পেয়েছেন তিনি। তাঁর মতে - "বিদেশের মানুষ পটশিল্পকে যতটা সম্মান দেয়, এ দেশের মানুষ ঠিক ততটা সম্মান দেয়না বললেই চলে।" দিনকাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকেও পাল্টে ফেলেছেন। নারী পাচার, নারী নির্যাতন, সুনামি, এইডস, নির্ভয়া কাণ্ড নিয়ে নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে উক্ত বিষয়গুলোও স্থান পেয়েছে তাঁর ছবি আঁকার বিষয়ে। আজকাল রাজ্যের বড়ো বড়ে মেলাতে তাঁর ডাক পড়ে৷ তিনি মেয়েদের জন্য পটচিত্রকলা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেন৷ তিনি তাঁর প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে আজ বাংলার প্রাচীন পটশিল্পকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন।

No comments