Header Ads

স্বর্ণযুগের বাঙালি উদ্যোগপতি। বাঙালির লক্ষ্মীলাভ



ছোটবেলায় পুজোর সময় খবরের কাগজে বাটা কোম্পানির পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দেখতাম ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’। বাটা ছিল বিদেশী প্রতিষ্ঠান, পৃথিবী জোড়া নাম। কলকাতার কাছেই ছিল কারখানা। এখন যে পুজোর সময় দুই-তিন পাতা জোড়া জুতো কোম্পানির বিঞ্জাপনগুলো দেখা যায়, সেগুলি কিন্তু সব বাঙালি প্রতিষ্ঠানের। আজ্ঞে হ্যাঁ! শ্রীলেদার্স, খাদিম, অজন্তা এরা সবাই বাঙালি। বিশাল সাম্রাজ্য আর ঝাঁ চকচকে শো-রুম নিয়ে অত্যন্ত গৌরবের সাথে ব্যবসা চালাচ্ছেন এনারা।‌


আবার জাপান, জার্মানি, কোরিয়া ইলেক্ট্রনিক শিল্পে সাংঘাতিক শক্তিশালী হয়েও অমরগোপাল বোসের প্রতিষ্ঠান বোস কর্পোরেশন-এর হেডফোন আর স্পিকারের কাছে হার মেনেছে। সেরা ভারতীয় উদ্যোগপতিদের অন্যতম অমরগোপাল বোস কিন্তু নিছক টাকা রোজগারের জন্য ব্যবসাতে আসেননি (যদিও ২০০৭ সালে বিশ্বের ২৭১তম ধনী ব্যক্তি হিসাবে ফোর্বস এর তালিকায় থাকা তার নীট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), চেয়েছিলেন এমন কিছু করতে যা এর আগে কেউ কখনো করেনি। এবং সফলও হয়েছেন। ‌

রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ব্যাংক ব্যবসায়ের শেষ লাইসেন্স পেয়েছিল ইয়েস ব্যাংক ২০০৪ সালে, এক দশক পর গত বছর আম্বানিদের রিলায়েন্স ক্যাপিটাল, দেশের বৃহত্তম ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এল অ্যান্ড টি, শ্রীরাম ক্যাপিটাল,  আদিত্য বিড়লা, বাজাজ, আদানির মতো শিল্পগোষ্ঠীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাদেরকে পিছনে ফেলে ব্যাংক ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে তৈরি হয়েছে বন্ধন ব্যাংক। বাঙালির বাণিজ্য দক্ষতা আবার প্রমাণ করলেন চন্দ্রশেখর ঘোষ। দেশের সেরা বিস্কুট কোম্পানিগুলির মধ্যে অন্যতম ব্রিটানিয়া, কিন্তু অনেকেই জানেন না এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতা এক বাঙালি ভদ্রলোক, নাম ভুতো বোস। বর্তমান মালিকানা অবশ্য বাঙালির হাতে নেই তবে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিস্কফার্ম দেশের প্রথম সারির বিস্কুট কোম্পানিগুলিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। হ্যাঁ, এটিও বাঙালি প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণদাস পাল।‌

সাধন দত্ত (ডেভলেপমেন্ট কনশ্যালট্যান্টস), প্রনয় রায় (এন ডি টি ভি), প্রীতিশ নন্দী (প্রীতিশ নন্দী কম্যুউনিকেশনস), বিকি চক্রবর্তী (এলিট হোটেলস, সুইডেন), পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জী (দি চ্যাটার্জী গ্রুপ), সুমিত মজুমদার (ট্রাকটরস ইন্ডিয়া), অঞ্জন চ্যাটার্জী (স্পেশালটি রেস্টুরেন্টস), সঞ্জয় কুমার ঘোষ (সিমোকো), সুব্রত বাগচী (মাইন্ড ট্রি), বিক্রম দাশগুপ্ত (গ্লোবসিন)-র মতো বেশ কিছু নাম পাবেন সফল বাঙালির তালিকায়। জুয়েলারি ব্যবসায় রয়েছে পি সি চন্দ্র গ্রুপ, সেনকো, অঞ্জলি। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরানো ভেষজ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির একটি যা আজও এক বিশেষ ভূমিকায় সমহিমায়। বোরোলীন, ডাকব্যাকের বর্ষাতি, বেঙ্গল কেমিক্যালের ন্যাপথালিন আর ল্যাম্প ব্র্যান্ড ফিনাইলের বিকল্প তো আজও খুঁজে পাওয়া গেল না।

কাজেই বাঙালির দ্বা্রা ব্যাবসা হবেনা এটা মানা একটু মুশকিল। যদিও দুঃখ লাগে যে বাঙালির সম্বিত সেনগুপ্তর (সানশাইন কর্প) মতো ব্র্যান্ডিং বিশেষজ্ঞ আছে তাঁদের জবাকুসুম, লক্ষ্মীবিলাস, বসন্ত মালতি, তুহিনার মত জিনিষগুলি খালি উপযুক্ত বিপণন, মোড়কজাত কারণের অভাবের জন্যই আজ অস্তমিত।

যারা বলেন ক্যাপিটাল কোথায় যে বাঙালি ব্যবসা করবে তারা জেনে রাখুন, কাশিমবাজার জমিদার পরিবারের বউ সুপ্রিয়া রায় ১৯৯০ সালে কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোডে নিজেদের বাড়িতে চার লাখ টাকার পুঁজি সম্বল করে একটা খাবার দোকানের ব্যবসা চালু করেন। সুগার এন্ড স্পাইস নামের এই প্রতিষ্ঠানটি আজ বাণিজ্য জগতে এক সমীহ জাগানো নাম। এখন ব্যবসা করতে গেলে প্রচুর মূলধন লাগে এই ধারনাকে উনি অলীক প্রমাণ করে ছেড়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেছেন বন্ধনের চন্দ্রশেখর ঘোষের পুঁজি কত ছিল শুরুতে? যদি বলি মাত্র দু লাখ টাকা! বিখ্যাত নন-ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান পিয়ারলেসের ব্যবসা শুরু হয়েছিল মাত্র ৩০০ টাকা দিয়ে।

অতীত যুগের কীর্তির জয়গান করে আর আজকের কিছু সফল বাঙালির তালিকা দিয়ে বাঙালির দোষ আর দুর্বলতাকে আড়াল করছি না। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের স্বপ্ন একদিন সার্থক হবে, বাঙালি মস্তিষ্কের অপব্যবহার বন্ধ করে, নিশ্চিন্ত বেতনের লোভে দাসত্বের বদলে কর্মকুশল বাঙালি ব্যবসা ও বাণিজ্যে ধনাগমের পথ দেখাবে, তীক্ষ্ণবুদ্ধির বাঙালি উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখাবে, সেই ভরসাতেই এই রচনা !


তথ্য :বাঙালির ইতিহাস, ডক্টর নীহাররঞ্জন  রায়। বিজনেসে বাঙালি ,শংকর।

No comments