Header Ads

স্মরণীয় মানুষ বরণীয় বাঙালি নরেন্দ্রনাথ দত্ত


নরেন্দ্রনাথ দত্ত কে চেনেন ? 
না না আমি সিমলে দত্তবাড়ির বড়ো ছেলের কথা বলছিনা, ইনি কুমিল্লার শ্রীকাইল গ্রামের বাসিন্দা। তবে প্রথমজন যেমন বিবেকানন্দ নামে খ্যাত, ইনি পরিচিত ক্যাপ্টেন দত্ত নামে। ১৮৮৪ সালে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম অত্যন্ত মেধাবী ছেলেটি গ্রামের মাইনর স্কুলে জলপানি পেয়ে পড়াশোনা করতেন। ক্লাস সেভেনে উঠে কুমিল্লা জেলা স্কুলে এসে ভর্তি হন। স্কুলের ফিজ নয় দিতে হতো না, কিন্তু অন্য খরচা? বাধ্য হয়ে খরচ চালানোর জন্য গ্রাম থেকে শাকসবজি এনে কুমিল্লা শহরে বিক্রি করতেন। স্কুলের পর বাবুদের বাগানেও কাজ করেছেন। হোস্টেলে ফি দিতে না পারায় দিনের পর দিন থেকেছেন প্রায় অনাহারে।


সেই আমলে এফ.এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পেয়ে ১৯০৯ সালে ডাক্তারি পড়তে  চলে আসেন কলকাতায়। এখানেও তাঁর একই সমস্যা, স্কলারশিপের টাকায় পড়াশোনা চললেও অন্য খরচা চলে না। বাধ্য হয়ে খিদিরপুর ডকে রাতে জাহাজ থেকে মাল নামানোর কাজ করতেন। রোজ রাতে এজন্য হোস্টেল থেকে বেরুতে হয়। খবর পেয়ে ইংরেজ সুপার ভেবেছিলেন কোন বদনেশায় আক্রান্ত, কিন্তু ওনাকে অনুসরণ করে নিজের চোখে দেখে একদম হতভম্ব। এদেশের কোন ভারতীয় ছাত্র এভাবে ডাক্তারি পড়তে পারে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। এম বি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই প্রিন্সিপাল কর্ণেল ডা. ক্যালভার্টের সহায়তায় তিনি অস্থায়ীভাবে প্রেসিডেন্সী জেনারেল হাসপাতালে হাউজ সার্জনের পদে নিযুক্ত হন।

কিছুদিন চাকরির পরেই ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিসের ইমার্জেন্সি কমিশনে যোগ দিয়ে লেফটেন্যান্ট পদ লাভ করেন এবং মধ্যেপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। ইউফ্রেটিস নদীর তীরে এক সেনা হসপিটালে টানা নয় বছর কাজ করে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন আর তারপরেই চাকরি ছেড়ে দেন।

সালটা ছিল ১৯২৫। চাকরি না করে স্বাধীন ভাবে কিছু করার ইচ্ছা ছিল বরাবর, কিন্তু পুঁজির অভাব। দেখা হয়ে যায় ডাক্তার বিধান রায়ের সাথে। উনি ডাঃ নীলরতন সরকার, স্যার কৈলাসচন্দ্র বসু, ডা. চারুচন্দ্র বসু প্রমুখের উদ্যোগে ১৯১৯ সালে কলকাতায় বেঙ্গল ইমিউনিটি নামে একটি সংস্থা খুলেছিলেন। সময়ের অভাবে তাঁরা কেউই ঠিকভাবে দেখাশোনা করতে পারছিলেন না। বিধান রায় ক্যাপ্টেন দত্ত কে সংস্থার ভার নিতে অনুরোধ করলে সানন্দে রাজি হলেন তিনি।

১৯২৭ সালে বরাহনগরে চোদ্দ একর জমি কিনে সেখানে বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানি সরিয়ে নিয়ে আসেন। তৈরি হয় আধুনিক কারখানা ও শ্রমিক আবাসন। কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন হোস্টেল সহ বিদ্যালয় । পরে এটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয় এবং তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে নাম রাখা হয় নরেন্দ্র বিদ্যামন্দির।

নিজে পড়াশোনা চালাতে কষ্ট পেয়েছেন বলে, জন্মভূমি শ্রীকাইলেও একটি স্কুল ও কলেজ স্থাপন করে গেছেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কুমিল্লার ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবার উপক্রম, তিনি ওদেশে গিয়ে নিজের টাকায় একটি ট্রাস্টি গঠন করে তাদের হাতে দিয়ে আসেন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার। লাখ লাখ উদ্বাস্তুদের আশ্রয় সমস্যার সমাধানে জমি কিনে পশ্চিমবঙ্গে শুরু করেন স্বল্প মূল্যের আবাসন। সেদিক দিয়ে এদেশে রিয়েল এস্টেট ব্যাবসার পথিকৃৎ ছিলেন ক্যাপ্টেন দত্ত। বিধান রায়ের সাথে সখ্যতা থাকলেও রাজনৈতিক ভাবে কোন সুযোগ নিতে চাননি। বরঞ্চ প্রথম রাজ্য মন্ত্রী সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবার প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।

তবে এসব কারণের জন্য তিনি স্মরণীয় নন। এদেশে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে 'সিরাম' উৎপাদন তিনিই শুরু করেন বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানিতে। তার জন্য আস্তাবল তৈরী করে রাখা হতো প্রচুর ঘোড়া। সাপ ও কুকুর কামড়ানোর প্রতিষেধক ইঞ্জেকশন একচেটিয়া ভাবে তৈরী হতো এখানে। কোম্পানির ওপর প্রথম আঘাত আসে আয়কর সম্পর্কিত এক মামলায়। আচমকা নেমে আসা এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে মারা যান নরেন্দ্রনাথ দত্ত। দীর্ঘ দশবছর ধরে চলা মামলায় কোম্পানির অবস্থা যথেষ্ট খারাপ হয়ে যায়। দ্বিতীয় আঘাত আসে মানেকা গান্ধী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন ঘোড়ার রক্ত থেকে সিরাম তৈরি বন্ধ করে দেওয়ায় । নব্বইয়ের দশকে কেন্দ্রীয় সরকার অধিগ্রহণ করলেও এর হাল ফেরেনা। ধুঁকতে থাকা কোম্পানি ২০০৫ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। 

অথচ শতাব্দী প্রাচীন সংস্থাটির হাতে রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি। বরানগরের ইউনিটটি এখন অসামাজিক কাজকর্মের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোজ রাতেই জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। শুধু এখানেই রয়েছে ১৪.‌০৫ একর জমি। বেঙ্গল ইমিউনিটির সদর দপ্তর ওয়েলিংটনে রয়েছে ৩ একর জমি। মল্লিকবাজারে রয়েছে ৪ একর জমি। টবিন রোডে ৯ একর জমি রয়েছে। বেলঘরিয়ায় ২৩৪ বাস স্ট্যান্ডের কাছে ৪ একর জমি রয়েছে। এখানেই ঘোড়ার আস্তাবল ছিল। এছাড়া কৃষ্ণনগরে জমি রয়েছে দেড় একর। দেরাদুনে রয়েছে ৩৫ একর জমি। এসব সম্পত্তি সাক্ষী দেয় ক্যাপ্টেন দত্ত কতো মজবুত করে গিয়েছিলেন কোম্পানির বুনিয়াদ ! 

পূর্ব ভারতের একমাত্র সিরাম তৈরির কারখানা টিকিয়ে আবার কি আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা যায়না? চন্দ্রবোড়ার কামড় খেয়ে অন্তত অনুপ বাবুর মতো আর কাউকে তাহলে বেঘোরে মরতে হয়না। সদিচ্ছার অভাব নাকি বাঙালি কোম্পানি বলে সরকারের অনীহা ?

No comments