Header Ads

'মাটি' - ছিন্নমূল বাঙালির শিকড় খোঁজার গল্প


         
বেশ কিছুদিন হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের যোগেশগঞ্জ এলাকায় থাকার দরুণ সামনে থেকে বাংলাদেশ দেখার সুযোগ হয়েছে,তবে আমার আর বাংলাদেশের মাঝে বয়ে গেছে রায়মঙ্গল নদী। তাই তাকিয়ে থেকেছি অপলক দৃষ্টিতে কিন্তু সাধ মেটেনি ছুঁয়ে দেখার সেই দেশের মাটি যা একদিন আমারও নিজের দেশ ছিল। নাহ, আমি বা আমার পূর্বপুরুষের কেউ বাংলাদেশ থেকে আসেননি। তবুও প্রফুল্ল রায়ের 'কেয়া পাতার নৌকা' অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে' ইত্যাদি উপন্যাস পড়ে আর বেলঘরিয়াতে থাকাকালীন সুন্দরবনের ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষজনের কাছে গল্প শুনতে শুনতে কখন যে আপন করে নিয়েছি ওপারের দেশটাকে নিজেই জানি না। কিন্তু আমি নাহয় অতি আবেগতাড়িত পাগল, কিন্তু ভাবুন তো সেই মানুষগুলোর কথা যাদের কৈশোর,যৌবন কেটেছে একটা দেশে আর বাকি জীবনটা কেটেছে বা কাটছে অন্য একটা দেশে তারা কিভাবে বুকের মধ্যে পুষে রেখেছে ফেলে আসা দেশটাকে। হ্যাঁ, এই ফেলে আসা দেশের মর্মস্পর্শী গল্প বলে শৈবাল ব্যানার্জী ও লীনা গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত 'মাটি' সিনেমাটি। 


ইতিহাসের অধ্যাপিকা মেঘলা বাংলাদেশ থেকে শান্তিনিকেতনে পড়তে আসা জিনিয়ার কাছ থেকে জানতে পারে জিনিয়া তাদের কুতুবদিয়ার(বাংলাদেশ) গ্রামের প্রতিবেশী। জিনিয়ার দাদু ও মেঘলার দাদু ছিলেন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। কিন্তু দেশ ভাগের আগুন থেকে রক্ষা পায়নি মেঘলার পরিবার।মেঘলার বাবা সত্যব্রত পুত্র-কন্যাদের নিয়ে এপার বাংলায় চলে এলেও মেঘলার ঠাকুরমা কুমুদিনী দেবী থেকে যান পূর্বপুরুষের ভিটেতে। বদলে যাওয়া মানুষজন ও সাম্প্রদায়িক হিংসার পরিস্থিতিও তার নিজের গ্রামের মানুষের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসায় চিড় ধরাতে পারেনি। কিন্তু সেই কুমুদিনী দেবী একদিন খুন হলেন বাড়ির তাঁরই বিশ্বস্ত কাজের লোকের ছুরিকাঘাতে।এই পর্যন্ত পড়ে মনে হতে পারে পরিচালকদ্বয় একটি বিশেষ ধর্মকে দোষারোপ করে এক তরফা গল্প বলেছেন। আসলে তা কিন্তু নয়, এই সিনেমার আসল বার্তা লুকিয়ে আছে জিনিয়ার বিয়ে উপলক্ষে ঠাকুমার লেখা ডায়েরিকে সম্বল করে মেঘলার নিজের মাটিতে ফিরে যাওয়া, সেখানে গিয়ে তার ঠাকুমার হত্যাকারীর নাতি জামিলকে লোকাল গাইড হিসেবে পাওয়া,জামিলের চোখ দিয়ে নতুন বাংলাদেশর শিকড়কে স্পর্শ করা ইত্যাদির ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে। আর সবটাই দর্শক অনুভব করবে জামিলের কাজ আর মেঘলার উপলব্ধি দিয়ে। তাই জামিলের মুখ দিয়ে পরিচালকদ্বয় যথার্থ অর্থে বলিয়েছেন যে ইতিহাসের বোঝা বয়ে বেড়ানোর দায় বর্তমান প্রজন্মের নয়,বরং অতীতের ভুল শুধরে নতুন বর্তমান তৈরি করাই আমাদের কর্তব্য। তাইতো জামিল মেঘলাদের বাড়িতে বসবাস করলেও ঠাকুর দালানে দুর্গা পূজা করে প্রতি বছর। কুমুদিনী দেবীর মহৎ কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিদেশের সুখের জীবন ছেড়ে গ্রামের স্কুল, হাসপাতাল, ঘুড়ি উৎসব ইত্যাদি চালিয়ে যায় আরো বেশি করে । সেই সঙ্গে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জারি রাখে তীব্র লড়াই। এই কাজে জামিলের সাথে থাকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম ও জামিলের মা আমিনা(সাবিত্রী চ্যাটার্জী) যার কাছ থেকে মেঘলা জানতে পারে খুন ধর্ষণ শুধু হিন্দুদের করা হয়নি, রাজাবাজারে আমিনার পরিবারের উপর অত্যাচারের কাহিনী আরো বেশি করে চোখ খুলে দেয় মেঘলার।আসলে জামিলের চোখ দিয়েই নতুন বাংলাদেশকে চিনতে পারে মেঘলা,অনুভব করতে পারে ইতিহাসকে, দেশভাগের যন্ত্রণাকে । তাইতো সকল কলুষতা ঘুচিয়ে স্মৃতিভারাক্রান্ত মন আর ফেলে আসা দেশের মাটি সঙ্গে করে এপারে ফেরে মেঘলা। তবে শুধু শিকড়ে ফেরার গল্প বলেনা এই ছবি, এখনকার একপেশে ইতিহাস ছড়িয়ে দেওয়ার রাজনীতি, আধুনিকতার নামে চেপে বসা মিথ্যাচার, ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় মৌলবাদ আর সব কিছু ঘুচিয়ে দুটো দেশ, দুটো আকাশ, দুটো হৃদয়কে একসূত্রে বাঁধার কথা বলে পুরো সিনেমাটি।


তাছাড়া এই ছবির মূল্যবান সম্পদ জামিলের চরিত্রে আদিল শেখ, মেঘলার চরিত্রে পাওলি, কুমুদিনীর চরিত্রে অপরাজিতা আঢ্য, আমিনার চরিত্রে সাবিত্রী চ্যাটার্জী, সত্যব্রতর ভূমিকায় চন্দন সেনের অনবদ্য অভিনয়। বিশেষ করে আদিল শেখ আপনার মনে আলাদা করে দাগ কেটে যেতে বাধ্য। এ ছবি থেকে সবচেয়ে বড় পাওনা এই ছবির গান।সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র তাঁর নিজস্ব মুন্সিয়ানায় দুই বাংলার লোকগানকে অসামান্য মাধুর্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত বিয়ের গান, মনসা ভাসানের গান, প্রভাতফেরির গান পুরো সিনেমায় আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। কুমুদিনী দেবীর নামাঙ্কিত স্কুল দেখতে গিয়ে প্রার্থনারত ছাত্রছাত্রীদের সুরে গলা মেলাতে বাধ্য হয় আবেগ তাড়িত মেঘলা। কারণ রবি ঠাকুরের লেখা"আমার সোনার বাংলা" গানটি যে আপামর বাঙালির অন্তরে রয়েছে। আর তাইতো সিনেমা দেখতে দেখতে মেঘলার সঙ্গে সঙ্গে কখন যে নিজের অজান্তে আপনিও গলা মিলিয়ে ফেলবেন টেরও পাবেন না। আমার মত হয়তো আপনার চোখের পাতাও একটু ভেজা ভেজা হবে। শান্তনু ঘোষের কণ্ঠে 'নিশা লাগিলো রে' আপনি অনেকদিন গুনগুনিয়ে গাইবেন।

গান ছাড়াও এ ছবির আরেক প্রাপ্তি মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মধুদার ক্যান্টিন {https://en.m.wikipedia.org/wiki/Madhur_Canteen}। তাই বাঙাল ঘটি বিভেদ ভুলে নিজের বাঙালি পরিচয়কে নিয়ে গর্ব করুন আর যারা বলেন এখন আর ভালো বাংলা সিনেমা তৈরি হয়না তাদের দেখান 'মাটি' সিনেমাটি।

No comments