Header Ads

শূন্য থেকে এক বাঙালি ব্যবসায়ীর আকাশ ছোঁয়ার কাহিনী

 
'ছেলেটাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। এই বুঝি ছেলেটা গোল্লায় গেল।' এভাবেই একটি ছেলেকে একটু অন্য চোখেই দেখতো গ্রামের লোকেরা। যে ছেলেকে নিয়ে সামান্য অবজ্ঞা ছিল গ্রামবাসীদের মনে। সেই ছেলেই একদিন গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করলো। শূন্য থেকে আকাশ ছুঁলো। সকল গ্রামবাসীকে চমকে দিলো। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে বাঙালি জাতির সম্মান বৃদ্ধি করলো। সেই ছেলে আজকে একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। যার নাম ঘনশ্যাম প্রধান। 


মেদিনীপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ফাজেলপুর। যে গ্রামে এখনও পৌঁছায়নি কোনো বিদ্যুতের আলো, নেই কোনো ভালো রাস্তাঘাট৷ এমনই একটি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেন ঘনশ্যাম প্রধান। ১৯৭৪ সালে মাত্র দুই বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হলেন। তাঁর দাদারা সংসারের হাল ধরলেন। তাঁকে নিজেদের স্বল্প আয়ে দাদারা স্কুলে ভর্তি করলেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করলেন দাদাদের সাহায্যে৷ এরপর উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য গ্রাম থেকে বহু মাইল দূরে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। সাইকেলে করে স্কুলে যেতে লাগলেন তিনি। সাইকেলে করে স্কুলে পৌঁছাতে তাঁর একঘন্টা লেগে যেতো। সংসারের অভাবের জন্য তিনি হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি। 

অত্যন্ত কষ্ট করে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এরপর কলেজে পড়ার জন্য তিনি ঠিক করলেন শহরে যাবেন৷ কিন্তু শহরে পড়াশোনার জন্য বিশাল খরচ রয়েছে। কে দেবে এই খরচ? কাজেই তিনি ঠিক করলেন শহরে দিনের বেলায় কাজ করে টাকা কামিয়ে রাত্রে পড়াশোনা করবেন। কথামতো তিনি কলকাতায় এলেন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। ভর্তি হলেন শ্যামাপ্রসাদ নাইট কলেজে কমার্স বিভাগে। তাঁর বড় দাদা কলকাতায় কাজের সন্ধান দেন৷ বড় দাদা তাঁকে পাকা ঘর-বাড়ি তৈরির কাজে নিযুক্ত করে দেন। তাঁর কাজ ছিল রাজমিস্ত্রীদের নজরদারি করা। বেশ কয়েকমাস দিনের বেলায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করে রাত্রিবেলায় কলেজে পড়াশোনা করতে লাগলেন। ঘড়ির কাঁটার মতো পার হতে লাগলো তাঁর সময়।

তিনি হঠাৎ একদিন স্থির করেন যে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রাজমিস্ত্রীর কাজে অনেক পরিশ্রম রয়েছে। তাঁকে কম খাঁটুনির কিছু একটা কাজ জোগাড় করতে হবে। এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে কোথায় যেন একটা বিজ্ঞাপন দেখেন যে ডে জব পেকার্স এন্ড মুভার্স বলে এক সংস্থা প্রচুর কমার্সের ছেলে নিয়োগ করছে। যে সংস্থার কাজ হলো এক বাড়ির আসবাবপত্র অন্য বাড়িতে কিংবা অন্য শহরে গাড়িতে করে ডেলিভারি দেওয়া। তিনি এই সংস্থাতে কাজ আরম্ভ করলেন। দিনের শেষে তাঁর পকেটে ঢুকতে লাগলো তিনশো টাকা। তিনি মনে মনে কিছুটা শান্তি অনুভব করলেন। 

সংসারের দারিদ্র্য মোচনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে লাগলেন। মন দিয়ে ডে জব পেকার্স এন্ড মুভার্সে কাজ করে যেতে লাগলেন। কাজের সূত্রে তিনি অনায়াসে শিখে ফেললেন টাইপিং করা, কম্পিউটারের ব্যবহার, ব্যবসার স্ট্রাটেজি প্রভৃতি। মাসের শেষে তিনি ২২০০ টাকা উপার্জন করতে লাগলেন। মাঝখানে তিনি ইনক্রিমেন্টের প্রত্যাশা খারিজ করে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের থেকে অর্থ উপার্জনের পথ বানাতে হবে। সেইমতো তিনি চাকরি ত্যাগ করে ব্যবসাতে মনোনিবেশ করলেন। তাঁর দাদাদের আপত্তি ছিল এই কাজে। কেউ কেউ বলতে লাগলেন যে তিনি বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়েছেন। যাইহোক তিনি কোম্পানির নাম রাখলেন পারফেক্ট প্যাকার্স এন্ড মুভার্স। মাত্র ত্রিশ টাকা খরচ করে ব্যবসা ধরলেন।  

কোনো সহকর্মী বা কর্মচারী ছাড়াই তিনি আসবাবপত্র ডেলিভারির কাজ একা একাই করতে লাগলেন। ব্যবসা করার জন্য আশ্রয় নিলেন একটি টালিবাড়িতে। দূর দূরান্ত থেকে বড় অর্ডার আসতে থাকে। ব্যবসার মোটামুটি উন্নতি হতে থাকে। এবার একটি লোক রাখলেন তাঁর ব্যবসায়িক কাজে সহায়তার জন্য। কিছুদিন পর তিনি মোটা অঙ্কের টাকা পেতে শুরু করলেন। এর পাশাপাশি মার্কেটিং নিয়েও একনাগাড়ে কাজ করে গেলেন। তাঁর কোম্পানির কাজ দেখে একটি মাল্টি ন্যাশনাল সংস্থা তাঁর সাথে যোগাযোগ করে। এই সংস্থার তরফে প্রচুর কাজের অফার পান তিনি। দ্রুততার সাথে শেষ করতেন তিন সর্বস্র কাজ। তিনি কর্মসূত্রে গাড়িতে করে গোটা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে অর্ডার সংগ্রহ করতে লাগলেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেন। 

কোম্পানি অনেক দূর এগিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে কোম্পানিতে কর্মীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। তারপর তিনি প্রধান রিলোকেশন প্রাইভেট লিমিটেড বলে আরেকটি কোম্পানি স্থাপন করে বসলেন। এই হলো তাঁর অতীতের গল্প। 

বর্তমানে তাঁর ক্লায়েন্ট তালিকায় রয়েছে টাটা টেলিকম, ইউবি স্পিরিটস, এয়ায়টেল, এলএনটি, নেসলে, আইডিয়া সেলুলার, টাটা টেলে সার্ভিস, বায়ার ক্রুপ সায়েন্স, ইয়ামাহার মতো নামীদামী সব কোম্পানি। তাঁর প্রধান রিলোকেশন প্রাইভেট লিমিটেড জাহাজের ক্যাপ্টেনের কেবিন প্রস্তুতকারক সংস্থা প্যাগোডা ইঞ্জিনিয়ারিয়ের শিল্পজাত পণ্য রপ্তানির কাজ করে থাকে। তাঁর কোম্পানির হেড অফিস রয়েছে কলকাতা ও ভুবনেশ্বরে। আগামীদিনে আরো অনেক জায়গায় তিনি কোম্পানির শাখা প্রতিষ্ঠা করতে চান। 

শূন্য থেকে আকাশ ছোঁয়ার জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন তিনি। সৎ ও নিষ্ঠার সাথে দারিদ্র্যতা জয় করে আজকে তিনি একজন সফল বাঙালি ব্যবসায়ী। যিনি দুই বছর বয়সে হন পিতৃহারা। কৈশোর কাটতে না কাটতেই হন মাতৃহারা। নিজের শৈশব ভুলে গিয়ে তিনি প্রচন্ড কষ্ট করেছেন। আজকে তাঁর কোম্পানির টার্নওভার প্রায় তিন কোটির। ভারতের মার্কেটিং রিপোর্ট অনুযায়ী আগামী পাঁচ ছয় বছরে তাঁর কোম্পানির টার্নওভার দশ কোটিতে পৌঁছানোর প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ত্রিশ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে তিনি আজ তিনশো কোটি টাকার মালিক। তিনি বাঙালির গর্ব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা ৷

1 comment:

  1. পড়ে আনন্দ হলো, গর্ববোধ ক‍রছি। বাংলার ঘরে ঘরে এমন আরও মানুষের জন্ম হোক।
    একটু শুদ্ধ বাঙলা বানান লেখার প্রয়য়োজন আছে।

    অরবিন্দ বন্দ‍্যোপাধ্যায়

    ReplyDelete