Header Ads

বাংলার গুটেনবার্গ পঞ্চানন কর্মকার



মুদ্রণ প্রযুক্তির উন্নতিতে বর্তমান যুগে আমরা নানা ধরণের বইপত্তর দেখতে পাই।বিশ্বের বই বাজারের সাথে তালে তাল রেখে এগিয়ে চলেছে বাংলা মুদ্রণশিল্প।আজ বাংলায় বহু অভিজাত্য প্রকাশনা সংস্থার মুদ্রণাক্ষরের শৈলী, মুদ্রিত বইয়ের ছবি,প্রচ্ছদ ইত্যাদি পাঠককে দুর্নিবার আকর্ষণ করে তাই অনেক বাংলা বইয়ের চাহিদা আজও তুঙ্গে।মুদ্রণশিল্পের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি,যন্ত্র এবং বাংলা মুদ্রণাক্ষরের নানা আধুনিক সফটওয়্যার আমাদের বাংলাকে প্রকাশনার জগতে উজ্জ্বল করে রেখেছে।আমরা তো সবাই কমবেশি বাংলা বই পড়ি।বাংলা হরফ ডেস্কটপ কম্পিউটারে লিখতে হামেশাই আধুনিক সফটওয়্যার যেমন অভ্র,বাংলা ওয়ার্ড,বিজয় ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকি।তেমনি মোবাইলে বাংলা হরফ লেখবার জন্য রিদ্মিক কিবোর্ড, জিবোর্ড, গুগল ইন্ডিক কিবোর্ড ইত্যাদি নানা ব্যবহার করে থাকি কিন্তু আমরা কজন বাংলা মুদ্রণাক্ষরের স্রষ্টা পঞ্চানন কর্মকার কে মনে রেখেছি? ইউরোপীয় ভাষার অক্ষর নির্মাণের ইতিহাসে জোহান গুটেনবার্গ(১৩৯৮- ৩রা ফেব্রুয়ারি,১৪৬৮) এক উল্লেখযোগ্য নাম।তিনি সর্বপ্রথম কাঠের অক্ষর দিয়ে ছাপাখানার কাজ শুরু করেন।তাঁকে আমরা সবাই মনে রেখেছি। আবার বিস্মৃতপ্রায় পঞ্চানন কর্মকারও আঠারো শতাব্দীর বাংলার সেরা মুদ্রণশিল্পের প্রযুক্তিবিদ এবং মুদ্রণ শিল্পে বাংলা হরফের জনক।তাই, তাঁকেও আমরা বলতেই পারি বাংলার গুটেনবার্গ

শ্রীরামপুর পৌরসংস্থার পরিচয়জ্ঞাপক ফলকে পঞ্চানন কর্মকারের ছবি(ছবির সূত্রঃ-এই সময় পত্রিকা)

পঞ্চানন কর্মকার জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান হুগলী জেলার ত্রিবেণী গ্রামে।তাঁর জন্মতারিখ কবে তা জানা যায় না।এমন গুণী মানুষের কীর্তি তাঁর সময়কে ছাপিয়ে গেছে বহুদূর সুতরাং তাঁর জন্মতারিখ অধরা থাকলেও,তাঁর আবিষ্কার অধরা থাকেনি।পাঠকগণ শীঘ্রই তাঁর কাজ সম্পর্কে পরিচিত লাভ করবেন

জানা যায় যে, তাঁর পূর্বপুরুষরা পেশায় ছিলেন কর্মকার বা লৌহজীবী।কিন্তু বেশ কয়েক পুরুষ আগে পঞ্চাননরা ছিলেন লিপিকর এবং সেই পূর্বপুরুষদের উপাধি ছিল মল্লিক। তাম্রপটে, অস্ত্রশস্ত্রে অলঙ্করণ বা নামাঙ্কনের কাজে তাঁরা ছিলেন যাকে বলে এক্সপার্ট তাই,বলা যায় পূর্বপুরুষদের এই শিল্পবৃত্তির গুণপনাটি পঞ্চানন কর্মকারের মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছিল।তাঁর পূর্বসূরিরা প্রথমে ছিলেন হুগলি জেলার অন্তর্গত জিরাট বালাগড়ের অধিবাসী, পরে অবশ্য ত্রিবেনীতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।


             
পঞ্চানন যখন ত্রিবেণীতে কর্মকারের কাজ করতেন তখন খ্রিস্টান মিশনারি ফাদার এন্ড্রুজ সাহেব হুগলিতে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৭৮ সালে ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ও বৈয়াকরণিক ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড(Nathaniel Brassey Halhed) (১৭৫১-১৮৩০) লিখিত এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ (A grammar of the Bengal language)’  পুস্তকটি এন্ড্রুজের প্রেসে ছাপানোর সময় বাংলা মুদ্রাক্ষরের দরকার হয়। তাই, ১৭৭৮ সালে যখন ইংরেজ মুদ্রাকর এবং প্রাচ্য ভাষাবিদ স্যার চার্লস উইলকিন্স(Charles Wilkins) (১৭৪৯-১৮৩৬)এই বইটি মুদ্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখন পঞ্চানন কর্মকার তাঁর মুদ্রণশিল্পের  সমস্ত প্রযুক্তিজ্ঞান দিয়ে উইলকিন্সকে  সাহায্য করেন এবং উইলকিন্সের তত্ত্বাবধানেই  পঞ্চানন তাঁর ব্যবহারিক প্রযুক্তিজ্ঞান দিয়ে ধাতব হরফ তৈরি করেন।অর্থাৎ স্যার চার্লস উইলকিন্স যখন ছাপার জন্য বাংলা অক্ষর তৈরি করেছিলেন তখন পঞ্চানন কর্মকারই তাঁর সহযোগী ছিলেন। উইলকিন্স ও পঞ্চাননের যৌথ উদ্যোগে মুদ্রণজগতে আসে এক বিরাট বিপ্লব কেননা তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রথম বাংলা মুদ্রণাক্ষরের প্রচলন হয়।এছাড়াও বইটির মুদ্রণে ছেনিকাটা, ঢালাই করা চলনশীল বা বিচল যে ধাতব হরফ ব্যবহার করা হয়, তা উইলকিন্স এবং পঞ্চাননবাবুর যৌথ প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছিল।তাই এই বই বলা যেতে পারে বাংলা হরফের মুদ্রিত প্রথম বই।এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে চার্লস উইলকিন্স কেবলমাত্র বাংলা নয় ফরাসি মুদ্রাক্ষরের আধুনিক আকৃতির উদ্ভাবক।বলা যায় যে,বাংলা মুদ্রণযন্ত্রের এক ইতিহাসের সূত্রপাত ঘটে এই গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে।এই উইলকিন্স আবার কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। এরপরে তিনি প্রেসে হরফ তৈরি ও মুদ্রণকাজে আজীবন জড়িত থাকেন।জানা যায় যে, উইলকিন্সের কাছ থেকেই পঞ্চানন কর্মকার নাগরী ও ফারসি অক্ষরের খোদাইয়ের কাজ শিখে তার উন্নতিসাধন করেছিলেন।বলা যায়, পঞ্চানন কর্মকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে শ্রীরামপুর মিশনারিদের সাহচর্যে এক স্বর্ণযুগের রচনা করেছিলেন।যখন হুগলির জন এন্ড্রুজের সাহেবের সেই ছাপাখানা চলে যায় কোম্পানির হাতে এবং উইলকিন্স হন তার পরিচালক তখন মালিকানা বদলির সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাপাখানাও হুগলি থেকে কলকাতায় চলে আসে।যদিও কোম্পানির এই  ছাপাখানাই কলকাতা শহরের প্রথম ছাপাখানা নয়।যাইহোক, ছাপাখানাটি সেখান থেকে মালদহ চলে যায়।হুগলিতে সাফল্যের সাথে কাজ করার পর পঞ্চানন কর্মকারও  এখানে-সেখানে ঘুরে একটা সময় চলে আসেন কলকাতার গার্ডেনরিচে

১৭৯৯ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস(Warren Hastings) (১৭৩২-১৮১৮)-এর উৎসাহে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উইলকিন্স সেটির পরিচালনা করেন।কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে উইলকিন্স পঞ্চাননকে কলকাতায় নিয়ে যান এবং সেই ছাপাখানায় কাজ করার সুযোগ করে দেন।সেখানে কাজ করে পঞ্চাননের সুবিধাই হলো কেননা হরফ নির্মাণের কলাকৌশল তিনি অতি উত্তমরূপে আয়ত্ত করেছিলেন।হেস্টিংস সাহেবের খুব ইচ্ছা ছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে আর তাই ১৭৮৫ সালে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় চার্লস উইলকিন্স এবং পন্ডিত পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায় ইংরেজি ভাষায় প্রথম ভগবদ্‌গীতা অনূদিত হয়।এই ভগবদ্‌গীতার ভূমিকা লেখেন স্বয়ং হেস্টিংস।তারিখ ও স্থানের জায়গায় ছিল যথাক্রমে ৭ই অক্টোবর, ১৭৮৪ এবং বেনারস।
                                                                            
আঠারো শতকের শেষে অর্থাৎ ১৭৯৯ সালে তাঁর সঙ্গে ইংরেজ ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি এবং ব্যাপ্টিস্ট মিনিস্টার উইলিয়াম কেরি(William Carey) (১৭৬১১৮৩৪)-র যোগাযোগ হয় এবং সে বছরই তিনি কেরি সাহেবের উদ্যোগে তিনি শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেসে যোগ দেন।এখানে জানিয়ে রাখি যে,কেরি সাহেব ছাপাখানা খোলার জন্যে বিলেতে মিশনারি কর্তাদের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে বিলেতের মিশনারি কর্তারা মিশনারিদের একটি দলকে ভারতে পাঠান। কিন্তু তখনকার দিনে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের সম্পর্ক ভালো না থাকার দরুণ তাঁরা ওই দলটিকে বাংলায় প্রবেশ করতে বাঁধা দিয়েছিল।তো সেই সময় শ্রীরামপুর দিনেমার বা ডেনিসদের উপনিবেশ হিসেবে ছিল আর কূটনৈতিক কারণে সেই সময় শ্রীরামপুরের ডেনিস শাসকেরা মিশনারিদের ওই দলটিকে আশ্রয় দিয়েছিল।১৭৯৯-এর ১৩ ই অক্টোবর, শ্রীরামপুরের মাটিতে পা দিলেন সেই মিশনারি দল যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক, লেখক, মুদ্রক ও অনুবাদক উইলিয়াম ওয়ার্ড, জোশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম গ্রান্ট, ডেভিড ব্র্যাডসন।আবার এদিকে নানা কারণে বিশেষত খরচের জন্যে,কেরি সাহেবের পক্ষেও মালদহের কাছে মদনাবতী অঞ্চলের খিদিরপুর গ্রামে মিশনারিদের ছাপাখানা খোলা সম্ভব হচ্ছিল না।তাই তিনি তখন শ্রীরামপুরের ডাচ শাসকদের আমন্ত্রণে ১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি ছাপাখানার সমস্ত  সরঞ্জাম নিয়ে শ্রীরামপুরে এলেন এবং সেই দিনটিতেই শ্রীরামপুরের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলশ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন এই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যে ছাপাখানাও পুরোপুরি চালু হয়ে গিয়েছিল আর সেই ছাপাখায় উন্নত মানের হরফ তৈরির জন্যে কেরি সাহেব কলকাতার গার্ডেনরিচ থেকে পঞ্চানন কর্মকার ও তাঁর জামাই মনোহর মিস্ত্রীকে শ্রীরামপুরে নিয়ে আসেন।আসলে,কোম্পানির কলকাতার ছাপাখানার কারিগর পঞ্চানন হরফ পিছু দর দিয়েছিলেন এক টাকা চার আনা যা দেওয়া কেরির পক্ষে সহজলভ্যই ছিল।আর কেরি সাহেবের ডাকে সাড়া দিয়েই পঞ্চানন কোম্পানির ছাপাখানার তৎকালীন কর্তা কোলব্রুক সাহেবের কাছ থেকে অল্প কিছু দিনের ছুটি নিয়ে মাসখানেকের মধ্যেই যোগ দিয়েছিলেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে। যাইহোক, সেই ছাপাখানায় একটি পুরনো যন্ত্র দিয়ে প্রেসের কাজ শুরু হলেও পঞ্চাননের মেধা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে অল্প দিনের মধ্যেই এই প্রেস শুধু ভারত কেন এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম অক্ষর তৈরি কারখানা(type foundry)-তে রূপান্তর হয়।সুতরাং বলাই যায় যে একটি পুরাতন প্রেস ও পঞ্চানন কর্মকারকে নিয়ে শ্রীরামপুর মিশনের যে ছাপাখানার পত্তন হয়েছিল তা কালক্রমে পঞ্চাননের সুদক্ষতার ফলে এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর নির্মাণ কারখানার মর্যাদা লাভ করে।এখানে উল্লেখ্য যে,১৮০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম থেকেই তিনি শ্রীরামপুরে খ্রীষ্টান ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের ছাপাখানায় কাজ করতে শুরু করেন। ১৮০১ সালে তাঁর তৈরি বাংলা হরফে উইলিয়াম কেরি অনূদিত বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টছাপা হয়।তিনি কেরীর সংস্কৃত ব্যাকরণের জন্য তৈরি করেন। ভারতবর্ষে নাগরী ভাষায় হরফ তৈরি এটাই প্রথম।



১৮০৩ সালে উইলিয়াম কেরি তাঁকে নাগরী অক্ষরের একটি সাঁট(শর্টহ্যান্ড )’ রচনায় নিযুক্ত করেছিলেন।বলা যায়,পঞ্চানন কর্মকারই ভারতবর্ষের প্রথম দেবনাগরী বা নাগরী ভাষায় এক সাঁট নাগরী হরফ নির্মাণ করেন যা তিনি তৈরি করেছিলেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে কেরি সাহেবের সংস্কৃত ব্যাকরণ মুদ্রণের জন্যে এবং এখানে উল্লেখ্য এই যে, এটাই ছিল ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম নাগরী হরফ নির্মাণের কাজ।এরপরে অর্থাৎ হরফ নির্মাণের কাজে নিযুক্ত থাকাকালীনই তিনি আরও ছোট অথচ স্পষ্ট এবং সুন্দরতম এক সাঁট বাংলা হরফ এবং তার নকশা তৈরি করেন যা বাংলা মুদ্রণশিল্পে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল।শ্রীরামপুর মিশন তাঁর অবদান ভোলেনি এবং সেই কারণে তাঁকে নিয়ে শ্রীরামপুরে একটি টাইপ-ঢালাইয়ের কারখানা প্রতিষ্ঠা করে।
               
জানা যায় যে,পঞ্চানন তাঁর জামাতা মনোহর মিস্ত্রী(যদিও অনেকে লেখেন মনোহর কর্মকার)-কেও এই অক্ষর নির্মাণ ও টাইপের কাজ শেখান এবং দীর্ঘ ১৮ বছর মেধা ও নিষ্ঠা দ্বারা বাংলা, আরবি, ফারসি, গুরুমুখী, মারাঠি, তেলেগু, বর্মি, চীনা ইত্যাদি ১৪টি ভাষার বর্ণমালার হরফ বা টাইপ তৈরি করে তিনি ও তাঁর জামাতা মিলে মুদ্রণশিল্পকে আরও সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করেন। বাংলার মতোই তাঁর প্রস্তুতকৃত সমস্ত হরফের ব্যবহার বহুদিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
                            
বৃদ্ধ বয়সে পঞ্চানন পুস্তক প্রকাশনার জন্য ছবি কাটতে এসেছিলেন শ্রীরামপুরের তথা বাংলার মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের আদি স্থান বটতলা’-য়। সেখানে তাঁরা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন  
               
শেষ বয়সে তিনি তাঁর জামাতা মনোহর কর্মকারকে সযত্নে তাঁর সমস্ত জ্ঞান ও হরফ নির্মাণের কলাকৌশল শিখিয়ে দিয়ে যান।বাংলা মুদ্রণাক্ষরের জনক পঞ্চানন কর্মকার ১৮০৪(যদিও কেউ কেউ লেখেন ১৮০৩)সালে পরলোকগমন করেন। মনোহর মিস্ত্রীও পঞ্চানন কর্মকারের মতোই পরিশ্রম, সাধনা ও মেধা পাথেয় করে আরবি, ফারসি, গুরুমুখি, মারাঠি, তেলুগু, বর্মি, চীনা প্রভৃতি অন্তত চোদ্দোটি বিভিন্ন ভাষার হরফ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।তাই বলা যায় মনোহর হরফ নির্মাণের উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে আরও ব্যাপকভাবে ব্রতী হয়ে পঞ্চানন পন্ডিতের দেওয়া শিক্ষার মান রক্ষা করেন। কি বলা যায় একে?  এই মুদ্রণাক্ষরের নির্মাণের জগতে নিজের মতো আরেকজনকে অর্থাৎ উত্তরসূরিকে তৈরি করে দিয়ে যাওয়া। যাতে সেই উত্তরসূরির হাত ধরে হরফ নির্মাণের কাজ আরো উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়।বলাই যায় যে, পঞ্চাননের জামাই মনোহর এবং দৌহিত্র(কন্যার পুত্র) কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সৃষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলএখানে উল্লেখ্য এই যে, কৃষ্ণচন্দ্রের দুই ভাই রামচন্দ্র ও হরচন্দ্র অধর টাইপ ফাউন্ড্রিনামে এক হরফ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বর্ণপরিচয়ছাপার সময়ে বর্ণপরিচয়ের অক্ষর ওই ফাউন্ড্রি থেকে তৈরি করিয়েছিলেন


                       
গুটেনবার্গের নামে বিশ্বের নানা বিষয়ের বইপত্র ও দস্তাবেজের এক অনলাইন আর্কাইভবা সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে যার নাম প্রজেক্ট গুটেনবার্গ’(-বুক আবিষ্কর্তা প্রয়াত মাইকেল এস.হার্ট যা তৈরি করেন ১৯৭১ সালে) কিন্তু পঞ্চাননের নামে?পঞ্চাননের নামে আমরা কি করেছি?এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে,এক জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে জানতে পারি যে, পঞ্চানন কর্মকারের প্রত্যক্ষ বংশধর কেউ নেই।তাঁর মেয়ের দিকের যিনি আছেন তাঁর নাম বিমান মল্লিক।পঞ্চাননের বাড়ির  সংলগ্ন পুরো জায়গাটার নাম ছিল সাহেব বাগান।তাঁর বংশের যিনি আছেন তিনিই পঞ্চানন কর্মকারের বিশাল জায়গা এখন  প্রমোটারের হাতে দিয়েছেন আর প্রোমটারেরা সেখানে যে বহুতল বানিয়েছে সেই কমপ্লেক্সের নামটা পঞ্চাননের নামেই রেখেছে।পঞ্চানন কর্মকারের কারখানাটা বহুদিন ধরেই অবহেলায় পড়েছিল।কিন্তু এখন কি অবস্থায় আছে জানা নেই। একটি স্থানীয় সংগঠন বিস্মৃতপ্রায় পঞ্চাননের স্মৃতিরক্ষার কাজ  চালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। 

যতই আগে পরলোক গমন করুন না কেন বাংলা ভাষায় ছাপার ইতিহাসে প্রথম চলনসই বাংলা ও সংস্কৃত অক্ষরের ছাঁচ তৈরির অগ্রদূত হিসেবে পঞ্চানন কর্মকারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।দীর্ঘদিন ধরে তার প্রস্তুত করা হরফের ব্যবহার প্রচলন ছিল।আজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত বার্ষিকী নিয়ে আমরা সবাই মেতে উঠেছি।বাংলা বর্ণমালার নির্মাণে তাঁর অবদান অবশ্যই অনস্বীকার্য কিন্তু দুশো বছর আগে গত হয়ে যাওয়া পঞ্চানন কর্মকারের কাজকেও যেন আমরা ভুলে না যাই, তাঁর অক্ষর নির্মাণের অবদানও বিদ্যাসাগরের থেকে কোনো অংশে কম নয়।বর্ণমালা খোদাইয়ের কাজে পঞ্চানন কর্মকার যেন বর্ণমালার আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ঠিক তেমনি এই কাজে বেণীমাধব দে, কার্তিকচন্দ্র বসাকও উল্লেখযোগ্য নক্ষত্র হিসেবে বিরাজমান।আমরা যেন তাঁদেরকেও ভুলে না যাই কারণ এইসব কৃতী মানুষদের জন্যে আমরা আমাদের মাতৃভাষায় বিভিন্ন মাধ্যমে লিখতে,পড়তে ও বলতে পারছি। 


                           

No comments