Header Ads

বেতার পদার্থবিজ্ঞানের পথিকৃৎ শিশির কুমার মিত্র || শেষ পর্ব


১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। তখন পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার হাল খুব খারাপ। সরকারের বিশেষ অনুরোধে শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্ব নিলেন। দু’বছরের মধ্যে পুরো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটালেন। উচ্চমাধ্যমিকের নতুন সিলেবাস প্রবর্তন করলেন ১৯৫৭ সালে। নির্দিষ্ট সময়ে নতুন সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।


সারাদেশে যখন স্বদেশী আন্দোলন চলছে স্বাধীনতার যুদ্ধ চলছে – তখনও একটা দিনের জন্যও গবেষণা বন্ধ রাখেননি তিনি। প্রতিদিন ঠিক সাড়ে দশটায় অফিসে আসতেন। তাঁর ছাত্র ও সহকর্মীরা একদিনও এর ব্যতিক্রম দেখেননি। ক্লাসে লেকচার দেবার সময় একটা শব্দও অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতেন না। প্রতিটি লেকচারের প্রতিটি বাক্য নিঁখুতভাবে তৈরি করতেন তিনি। তাঁর ল্যাব, অফিস সবকিছু গোছানো থাকতো সবসময়। ছোট বড় যে কোন কাজই নিঁখুতভাবে করতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনে অনেক কষ্ট ছিল তাঁর, কিন্তু কাউকে প্রকাশ করতেন না। জন্মের কিছুদিন পরেই তাঁদের প্রথম সন্তান মারা যায়। পরে তাঁদের আরো দু’টো ছেলে হয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালে তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর খুবই একা হয়ে পড়েন তিনি। সন্তানদের নিজের হাতে মানুষ করেছেন – বাড়িতেও নিয়ম মেনেই সবকিছু চলতো। বিজ্ঞানের বাইরে শখ করে একটি কাজই করতেন তা হল রবিবারে বিকেলে কিছুক্ষণ দাবা খেলতেন বন্ধুদের সাথে। সে খেলাও চলতো পুরোপুরি টুর্নামেন্টের নিয়মে।

১৯৬১ সালে এক দুর্ঘটনায় তাঁর বড় ছেলের মৃত্যুর পর ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু কাজের আড়ালে গোপন করে রাখেন নিজের শোক। ১৯৫৩ সাল থেকেই তাঁর হৃদরোগ ধরা পড়ে। তা ক্রমশ মারাত্মক আকার ধারণ করে। ১৯৬৩ সালে ‘অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা স্মারক বক্তৃতা’ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয় তাঁকে। তিনি বক্তৃতার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বছরের শুরু থেকেই। বক্তৃতার বিষয় নির্বাচন করেছেন “ফিজিক্স অব দি আর্থ’স আউটার স্পেস”। বক্তৃতার জন্য তথ্য জোগাড় করার দায়িত্ব দিলেন তাঁর প্রিয় ছাত্র এবং সহকর্মী ডক্টর মৃণাল দাশগুপ্তকে। তিনি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করে দিলেন। তিনি প্রতিটি শব্দ, বাক্য, বিষয়বস্তু নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত বক্তৃতা পরিবর্তন-পরিমার্জন করেই চলেছেন। বক্তৃতার দিন ২৯শে মার্চ। সেদিন ঠিক সাড়ে দশটায় অফিসে এসেই তিনি মৃণাল দাশগুপ্তকে ডেকে পাঠালেন। বললেন “বিক্রম সারাভাই তাঁর একটা সাম্প্রতিক একটা পেপার আমাকে পাঠিয়েছেন। উপরের বায়ুস্তরে চৌম্বক-ক্ষেত্র সম্পর্কিত কিছু নতুন তথ্য আছে সেখানে। তুমি কি একবার দেখবে আমার বক্তৃতার কোন জায়গায় এই নতুন তথ্যগুলো ঢোকানো যায় কি না”। তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছিল না কিছুদিন থেকে। সন্ধ্যাবেলা বক্তৃতার সময় শরীর আরো খারাপ হল। বক্তৃতার প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর বাকিটা আর পড়তে পারলেন না। বাকিটুকু পড়লেন মৃণাল দাশগুপ্ত। এর কয়েক মাস পর ১৯৬৩ সালের ১৩ই আগস্ট মারা যান তিনি।

তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব শিশির কুমার মিত্র। বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে চেনেই না। ১৯৫৮ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়েছেন শিশিরকুমার মিত্র।

গবেষণা ও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৩৫ সালে পেয়েছেন কিং জর্জ সিলভার জুবিলি মেডেল, ১৯৪৩ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশান অব সায়েন্সের জয়কৃষ্ণ মুখার্জি গোল্ড মেডেল, ১৯৫৬ সালে পেয়েছেন এশিয়াটিক সোসাইটির সায়েন্স কংগ্রেস মেডেল। ১৯৬১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৬২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার ও পদ্মভূষণ উপাধি পান এই মহান বিজ্ঞানী। ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেন ১৯৬২ সালে।

বাঙালির সময় এসেছে এইসব মহান মানুষদের কথা জানার এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এদের কথা জানানোর।


তথ্য - উইকিপিডিয়া , প্রদীপ দেবের মুক্তমনা ব্লগ

No comments