ছড়াকারের ছেলে বেলার মেয়ে বেলা!
"আমি
ছেলে হিসেবে জন্ম নিয়েছিলাম বলে মা হয়তো খুব বেশি আনন্দিত হননি।মা আশা করেছিলেন
আমি মেয়ে হব।" প্রথমেই
চমকিত হতে হয় লেখক "আমীরুল ইসলাম" 'ছেলেবেলার ছেলেখেলা' বইয়ের
প্রথম ভাগেই স্বপ্নবান এক ছেলেবেলা তৈরি হচ্ছে অতি দারিদ্রের মধ্যে। ষাটের দশকে এই
সমাজে সবার পরিবারে অনাগত সন্তান ছেলে হবে এ চাওয়াই ছিল, মেয়ে হলে পরিবারের
অনেকেই নাখোশ হত, এই
পরিবারে হল ব্যতিক্রম!
"ছেলেবেলার ছেলেখেলা" বইয়ের আরেকটু সামনে এগোলে দেখা
যায় লেখকের মায়ের মেয়ে সন্তানের ব্যাপারে খুব শখ ছিল পর পর অনেকগুলো ছেলে হবার
কারণে! এমনকি মা তাকে মেয়ে হিসেবে অনেকদিন সাজিয়ে গুজিয়ে রাখতেন!প্রথম দিকে স্কুলে
গিয়ে ক্লাসে মেয়েদের বেঞ্চে পর্যন্ত বসে ক্লাস করেছেন!একটু পরেই লেখক আমীরুল
বর্তমান নিজের নিজেকে নিয়ে সাফাই গাওয়া, "আমার মধ্যে মেয়েলী
ব্যাপার এখন বিন্দুমাত্র নেই" বইটি মূলত লেখকের ছেলেবেলার একান্ত দুমূর্ল্যরে
বাজারে অমূল্য স্মৃতি। এখানে ঘুরে ফিরে বারবার তার জীবনে প্রত্যেকটি ঘটনাবহ স্মৃতি
উঠে এসেছে। প্রত্যেক মানুষের শৈশব এক আশ্চর্য হাওয়াই মিঠাই যা বড় বয়স হলেই মিলিয়ে
যায়, চোখের
সামনে ভেসে উঠে একটু পর আবার মিলিয়ে যায়!
"ছোটবেলা
গরীবই ছিলাম আমরা।টানাটানির সংসার আমার মা নিপুণ হাতে সব পরিচালনা করতেন।" এখানে
সরল স্বীকারোক্তি লেখকের, সংসারের অর্থনৈতিক
দৈনতার কথা বলার এই সাবলীলতা দারিদ্রের প্রতি সভ্রম জাগায়। দারিদ্রও সুন্দর হতে
পারে তা লেখকের নিপুণ লেখনীর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। একসময় গ্রাম থেকে যারা ঢাকায়
জীবিকার প্রয়োজনে আসত তাদের প্রায় সবাইকে বলতে শোনা যেত আগে তার বড়দাদা জমিদার ছিল
এবং তাদের প্রচুর প্রতিপত্তি ছিল। কত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান তারা ছিল এটা
প্রমাণ করবার ব্যর্থ চেষ্টা সেই জমিদার নাতি-পুতিরা করতেন!
একজন
লেখকের লেখক হবার পিছনে নানান অনুষঙ্গের প্রয়োজন হয় তা মোটামুটি কম-বেশি
"আমীরুল ইসলামের" চারপাশেই ছিল।এর মধ্যে কবির বড়বাবা শিশু-সাহিত্যিক
হাবীবুর রহমান, যিনি
লেখকের কোমল মানসের প্রথম নায়ক বলে মনে হয়।বড়বাবার কিছু চারিত্রিক ব্যাপার লেখককে
নানা সময়ে প্রভাবিত করেছে এবং এই পরিণত বয়সেও করে চলেছে!
"বড়
আব্বা মাকে বললেন, তাকে তুমি বুকের দুধ
খাইয়ো না।ওর পুষ্টির জন্য প্রয়োজন ল্যাকটোজেন দুধ।একে ল্যাকটোজেন দুধ খাওয়াও।" এরপরই
পরিণত বয়সের নির্বিকার বর্ণনা "তখন প্রচলিত ধারণা
টিনের দুধ খেলে শিশু ভালো থাকবে। মায়ের দুধের চেয়ে টিনের দুধ স্বাস্থ্যের জন্য
পুষ্টিকর" বড়
আব্বা এসব জেনে এসেছিলেন বিদেশ থেকে। তখনকার দিনের সর্বাধুনিক ধারণাটি চাপিয়ে দিলেন
মায়ের ওপর" বইটির লেখনীতে নির্মোহ ভাব এখানেও লক্ষ করা যায়।
সবচেয়ে
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আমরা যে আমীরুল ইসলামকে শিশু-সাহিত্যিক হিসেব চিনি, তার
প্রথম শিশু মনটি সুন্দরভাবে তৈরি হয়েছিল, তার চারপাশের উচ্ছল
সুন্দর পরিবেশ থেকে।এর মধ্যে তার আব্বা তাকে এত এত গল্প জীবনে শুনিয়েছিলেন যে এখন
এই পরিণত বয়সে এসেও সেই শৈশবের কোমল হৃদয়ের স্মৃতির জন্যে মন হাহাকারময় হয়ে ওঠে, মাঝে
মাঝে ফিরে যাবার ইচ্ছা করে সেই অসচ্ছল সংসারের দারুণ সচ্ছল ছেলেবেলার প্রতি!একটা
কথা প্রচলিত রয়েছে, বাচ্চাদের প্রথম
শিক্ষাঙ্গণ হলো তার বাবা-মা।এখানে লেখকের বাবাকে দেখা যায় ছেলেবেলায় তার শৈল্পিক
সত্তাকে কি সুন্দরভাবে তৈরি করতে।
"আমার
আব্বা ঠাকুমার ঝুলির অনেকগুলো গল্প মুখস্থ বলতে পারতেন।গল্পের কথনভঙ্গি ছিল তার
অসাধারণ।চোখের সামনে তিনি ছবির মতো গল্পগুলো ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। আমরা আব্বার
পাশে শুয়ে শুয়ে রূপকথার গল্পগুলো শুনতাম আর টের পেতাম আমাদের সামনে দিয়ে ঘোড়া ছুটে
যাচ্ছে টগবগ করে।"
সব
শৈশবের থাকে আক্ষেপ, সে ধনী শৈশব বা
বিত্তহীনের শৈশবই হোক।এখানে দেখা যায় "আমীরুল ইসলামের" বিত্তহীন চিত্র-ভরপুর
শৈশবের জন্য হাহাকার যা হয়ত তার লেখনীর কারণে শিল্পিত রূপ পেয়েছে।কিন্তু ছেলেবেলায়
মনে হয় শিশু মানসপটে এর ছিল একটা চাপা নিদারুণ কষ্ট, এখন যেমন দেখা যায়
সহপাঠিরা কেউ গাড়ি নিয়ে স্কুলে আসে, আরেকজন হেঁটে বা
রিক্সায়।হয়তো সব কালে সব যুগেই পরিবেশ, উপকরণ এবং চারপাশের
চরিত্রগুলো শুধু পরিবর্তন হয়!
"স্কুল
জীবনে নতুন ক্লাসের বই কোনোদিনও পাইনি আমি।বাচ্চু ভাই কোনখান থেকে পুরোনো বই
সংগ্রহ করে এনে দিতেন, খড়খড়ে বাদামি কাগজের
মলাট লাগিয়ে মোটা সুতোয় সেলাই দিয়ে বই বাঁধাই করে নিতাম নিজ হাতে।শৈশবে খুব একটা
ছোটবেলায় নতুন বইয়ের গন্ধ কখনও পাইনি।এ নিয়ে কোনো আফসোস অবশ্য নেই।বড় হয়ে এই
পুরোনো বইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণ আরো বাড়ে।" এখানে শৈশবের হীনমন্যতা
দেখা যায় না, কিন্তু
দেখা যায় আক্ষেপের গল্প।প্রত্যেক মানুষ যখন পরিণত বয়সে তার নিজের পেশা বেছে নেয়, তার
আগে স্বপ্নের রঙ চড়িয়ে নানান বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখে ব্যর্থ হয়ে তারপর তার বর্তমান
পেশায় আসে।যেমন, লেখককে
দেখা যায় চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী হতে চেয়ে
ব্যর্থ হয়ে বর্তমান পেশায় বসে শৈশবের স্বপ্নের স্বপ্নময় কথার যাবর কাটতে!কিন্তু
পারিপার্শ্বিকতা বলে যে একটা কথা রয়েছে, সুযোগ পেলে যে কেউ তার
স্বপ্ন-সমান হতে পারতো হয়তো, অনেকে সে সুযোগ পায় কেউ
পায় না, লেখক
তা পাননি।কিন্তু পরবর্তীতে জীবনে তার সেই না পাওয়া থেকে তাকে চিত্রশিল্প ও
সঙ্গীতের সমঝদার করে তুলেছে।নিজের চিত্রশিল্পীর সত্তা এখানে অন্যদের চিত্রশিল্প
সংগ্রহ ও গান শুনে পুষিয়ে নিতে দেখা যায়!
এটি যেহেতু আত্মজীবনীমূলক বই তাই এখানে মাঝে মাঝেই লেখকের অনেক বিষয়ের অকারণ পুনরুক্তি ও পক্ষপাত দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কাটানো সময়, বাবা-দাদার সঙ্গে স্মৃতিচারণ।'৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে উত্তাল '৭১-এর সময়টা একটি শিশুর চোখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই সময়টা, সৃষ্টি করেছে একটা ছোট্ট শিশুর চোখে শিশু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।সেই সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের এখনকার আদিরূপ ১৯৭০ সালে কেমন ছিল তার একটা মচমচে প্রামাণ্য দলিল।এবং মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেও ঈদ পালন এবং যুদ্ধের মাঝে স্বাভাবিক জীবন যাপনের একটা নিটোল পাণ্ডুলিপি।
"ছোটবেলার
বৃষ্টির দিনগুলো খুব অন্যরকম লাগত।একবার বর্ষার দিনের কথা খুব মনে পড়ে।ভোরবেলা
থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে।" বর্তমান এই ইট-কাঠের
ঢাকার প্রকৃতিরও যে একটা শৈশব ছিল তা দেখা যায় এই বর্ণনায়, তার সঙ্গে এখনকার পটেটো
চিপস বা ফাস্ট ফুড ও সন্দেশগুলো চিরায়ত বাংলা ফলের জায়গা নিয়েছে, তাও
উঠে এসেছে এই দলিলে।স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর আর্থসামাজিক অবস্থার
চিত্রটাও এখানে ফুটে উঠেছে।ঐ সময় দারিদ্র ছিল, যাতনা ছিল কিন্তু
মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য এবং একান্নবর্তী পরিবারে ছিল ভালোবাসার বাঁধন, যা
পরে আশির দশক থেকে পাল্টে যেতে শুরু করে বর্তমান ইটকাঠের নাগরিক মনে পরিণত হয়েছে
মেগা-সিটি হয়েছে তখনকার মফঃস্বল শহর ঢাকা।
এই
বই যেহেতু একজনের ছেলেবেলার প্রামাণ্য দলিল সেহেতু তার পরিবারকেন্দ্রিক ঘটনাসহ
চারপাশের পরিবেশই বারবার ঘুরেফিরে এখানে আসবে, কারণ ছোট্ট শিশুর পক্ষে
তো আর বড়দের মত নানান পেশার মানুষের সাথে মেশা সম্ভব ছিল না!
লেখক
তার মায়ের কাছ থেকে বেশ প্রভাবিত ছিলেন প্রকৃতির নিয়ম মতো, যা লেখক অকপটে স্বীকার
করেছেন তার স্বীকারোক্তিতে।মা যেমন খাদ্যাভ্যাস করিয়েছেন সেই আটপৌরে মায়ের
অপর্যাপ্ত খাবার, কিন্তু
সুস্বাদু খাবারের গন্ধ এই প্রতিষ্ঠিত জীবনে করপোরেট সময়ের নাকে মাঝে মধ্যেই পেতে
দেখা যায়!" ক্লাস
ফোরে থাকার সময় ডিনা মৃত্যুবরণ করে। আমার জীবনে প্রথম মৃত্যু, অনেক
দুঃখ পেয়েছিলাম। কষ্ট হয়েছিল।" প্রতিটি কাছের মানুষের
মৃত্যুকেই মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় সবসময়, আর শৈশবে পরিবারের কোন
সদস্যের মৃত্যু দেখলে, তার দুঃখভারাক্রান্ত
স্মৃতি আক্রান্ত করে রাখে সারাজীবন। বেশ কয়েক জায়গায় লেখকের কথায় ঘুরে ফিরে আসে
ছোট ভাই ডিনার মৃত্যুর কথা।
"মা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই জীবনে।তাই মাকে ‘তুই’ করে বলতে নেই।মাকে 'আপনি' করে বলতে হবে।তারপর থেকে মাকে আজীবন 'আপনি' করে সম্বোধন করেছি।" পুরো বইতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে লেখক অসংখ্যবার মা এবং তার সম্পর্কিত অনেক স্মৃতি বলে চলেছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মত একই লয়ে, একই তালে কিন্তু তা পুনরাবৃত্তি মনে হয়নি।এই মায়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে হাজার বছরের বাঙালি মাকে।এখানে আর আলাদা করে আমীরুল ইসলামের মাকে বলে মনে হয় না, সে পাঠকের মা হিসেবেই ধরা দেয়।" মা মরে গেলে আমি এমন কষ্ট পাব যে আমি বেঁচে থাকতে পারব না। মাকে এই কথা বলতেই মা হাসতেন, 'আমি বলতাম শোন মা, তাই আমি তোমার আগে মরে যাব।তোমার আগে মরে যাব।'
মা
হাসতেন।বলতেন, 'পাগল
ছেলে!'মানুষের
মহাকাব্যিক জীবনে অনেক মৃত্যু আসে কিন্তু মায়ের মৃত্যুতেই মনে হয় সবাই অসহায় বোধ
করে সবচেয়ে বেশি, মানুষের
স্বভাবই তো নিজেকে নিরাপদ রাখা, নিজেকে নিরাপদ দেখা।জীবনের
সবচেয়ে বড় নিরাপদ স্থানটিই যখন ধসে যায় সে এক নিদারুন হাহাকার, যা
কোনো বিত্ত, জ্ঞান-গরিমা
দিয়ে ঢাকা যায় না, কেবল সবাই তা ঢাকার
চেষ্ট করে মাত্র।
ছেলেবেলার
ছেলেখেলাকে বলা যায় বাঙালির হারিয়ে যাওয়া শৈশবের ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতি মাত্র।বিখ্যাত
লেখকের অখ্যাত শৈশবের প্রামাণ্য দলিল!পড়ুয়া মাত্রই নিজের ছেলেবেলায় ছেলেখেলার সাথে
মিলিয়ে নিজের ও আমীরুল ইসলামের শৈশবের স্মৃতি দাঁড়িপাল্লায় ওজন করবেন।মাঝেমধ্যে হয়
পাঠকের শৈশব ভারী হবে, কখনো আমীরুল ইসলামের!
Post a Comment