Header Ads

সূর্য কিরণে ঢাকা পড়ে রইলেন বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার


১২ই জানুয়ারী ১৯৩৪, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে সেদিন কারো চোখে ঘুম নেই। মাঝরাতে ফাঁসি দেওয়া হবে মাস্টারদা কে। একই মঞ্চে ঐদিন ঝোলানো হবে আরও এক বিপ্লবী কে। তিনি তারকেশ্বর দস্তিদার । কিন্তু ইনি তো সেদিন অস্ত্রাগার দখলের লড়াইয়ে ছিলেন না! তাহলে?‌


মাস্টারদার সংগঠনে তারকেশ্বরের স্থান ছিল সাত নম্বরে। ডাকাবুকো এই যুবক ছিলো বোমা বানানোয় সিদ্ধহস্ত। বিদ্রোহ শুরু হবার মাসখানেক আগে পাহাড়তলীর এক নির্জন স্থানে বসে বানাচ্ছিলেন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা। উপকরণ ছিল পিকরিক অ্যাসিড আর গানকটন। আচমকাই হলো বিস্ফোরণ! মারাত্মক ভাবে আহত হলেন তারকেশ্বর। মুখ হাত তো পুড়ে গেছিলোই, কয়েক জায়গায় শরীরের হাড় অব্দি বেরিয়ে এসেছিল। তদারকি তে থাকা অনন্ত সিংহকে ঐ অবস্থায় অনুরোধ করেন তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে। শোনেননি অনন্ত তার সেই অনুরোধ, বদলে নিয়ে তোলেন তাকে এক গোপন ডেরায়। চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে সুস্থ হতে থাকেন তিনি, যদিও ডি ডে তে ভাগ নিতে পারেন নি।

জালালাবাদ যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। সবাই যখন ছত্রভঙ্গ,দলের হাল ধরলেন তারকেশ্বর। আহত অবস্থাতেও পলাতক সঙ্গীদের জন্য ঘুরে ঘুরে ব্যবস্থা করতে লাগলেন নিরাপদ আশ্রয়ের। মাস্টারদা তখন কানুনগো পাড়ার এমনি এক আশ্রয়ে, সাথে আছেন বিশ্বস্ত সাথী নির্মল সেন। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য দেখা করতে এলেন তিনি সাথে বীরেন দে। মিটিং শেষ করে বিকেলে দুজনে রাস্তায় বেরিয়ে দেখেন পিছু নিয়েছে এক গেঁয়ো চাষি। হাবভাব তো চাষির মতো নয়, সন্দেহ হলো তারকেশ্বরের। তাছাড়া খোদ মাস্টারদা রয়েছেন এলাকায়, কোন ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।

প্ল্যানমাফিক তাঁরা দুজন হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। থতমত খেয়ে পেছনের লোকটাও দাঁড়িয়ে পড়লো। এবারে আর চিনতে ভুল হলো না তাদের...এতো শশাঙ্ক দারোগা ! মাথায় হাত দুজনের, তবে কি মাস্টারদার আস্তানার খবর ও জেনে ফেলেছে ? আর তো তবে ছাড়া যাবে না। পথের শেষে একটা বাঁক, রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে। দুজন দুদিকে গিয়ে পজিশন নিলেন।

বাঁকের মুখে এসে থমকে দাঁড়াল দারোগা, ছোঁড়া দুটো গেলো কোনদিকে? কি ভেবে বরমা গাঁয়ের মেঠো পথ ধরলেন। বেচারা দারোগা বুঝতে পারেনি খড়ের গাদায় আড়ালে আর্মি রিভলবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন তারকেশ্বর। নাগালের মধ্যে আসতেই লুটিয়ে পড়লো শশাঙ্ক, সূর্যসেনকে ধরিয়ে দেবার দশহাজার টাকা পুরস্কার এ জনমে আর পাওয়া হলোনা !

২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩, গৈরালা গ্রামে ধরা পড়লেন মাস্টারদা। বন্দী করে আনা হলো চট্টগ্রাম জেলে। তবে কি যুব বিদ্রোহ এখানেই শেষ ? হাল ধরেছিলেন সেদিন সূর্য সেনের বিশ্বস্ত অনুগামী সেই তারকেশ্বর। সঙ্গীদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন মাস্টারদা কে জেল থেকে বের করে আনতে হবে। জাল ছড়াতে লাগলেন জেলের ভেতর। টাকা দিয়ে ওয়ার্ডারদের বশ করে জেলে পৌঁছে গেলো বিস্ফোরক থেকে রিভলবার। সেলের তালা খোলার জন্য ডুপ্লিকেট চাবি, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়ে গেলেন এই কাজে থাকা শৈলেশ রায়। ফাঁস হয়ে গেলো সবকিছু, পুলিশের নজরে চলে এলেন তারকেশ্বর দস্তিদার।

১৯শে মে ১৯৩৩, গহিরা গ্রামে পূর্ণ তালুকদারের বাড়িতে গোপন মিটিং এ এসেছেন ফেরার তারকেশ্বর। ছিলেন মনোরঞ্জন দাস, কল্পনা দত্ত সহ আরো অনেক পলাতক বিপ্লবী। খবর পেয়ে গ্রাম ঘিরে ফেলে পুলিশ। চললো গুলির লড়াই, কিন্তু আধুনিক হাতিয়ারের সামনে সামান্য রিভলবারের শক্তি আর কতটুকু? নিহত হলেন মনোরঞ্জন আর গৃহস্বামী পূর্ণ ও তার ভাই নিশি তালুকদার। ধরা পড়লেন কল্পনা ও তারকেশ্বর সহ বাকি বিপ্লবীরা। শোনা যায় ধরা পড়ার পর মেজর কিম তারকেশ্বর দস্তিদারকে বুট জুতা পরা পা দিয়ে লাথি মারলে তার চোখের ভেতর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। 

ফিরে আসি আগের কথায়.....
ফাঁসি দেওয়ার আগে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয় তাদের ওপর। হাঁতুড়ি দিয়ে মেরে ভেঙে দেওয়া হলো দাঁত, উপড়ে নেয়া হলো সবকটা নখ। অর্ধমৃত অবস্থায় তাদের দু'জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। শেষকৃত্যের জন্য মৃতদেহ আত্মীয়স্বজনের কাছে দেওয়া হয়নি। ভোর হওয়ার আগেই দেহ দুটি চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে একটা জাহাজে তোলা হয়। মৃতদেহের সাথে বেঁধে দেওয়া হলো বেশ কিছু ভারী পাথর আর তারপর ?

একটু গভীরে গিয়ে ডুবিয়ে দেওয়া হলো তাদের নশ্বর দেহ ‌।

দুঃখের কথা একই মঞ্চে দু'জন প্রাণদান করলেও ওই ফাঁসির মঞ্চে শুধু বিপ্লবী মহায়নায়কের নাম লিপিবদ্ধ আছে। সূর্য কিরণে ঢাকা পড়ে রইলেন বিপ্লবী তারকেশ্বর।

No comments