Header Ads

জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন ‌



১লা মে ১৯৩৯ সাল, আলিপুর জেলের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো বেশ লম্বা ছিপছিপে এক রমণী। গায়ের রঙ দেখে অবাঙালী বলে ভুল হয়। গেটে অপেক্ষা করছিলেন বাবা ও মাসতুতো ভাই সুবোধ রায়।  তবে এত তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবার কথা নয়, খোদ রবীন্দ্রনাথ দীনবন্ধু এন্ড্রুজকে সাথে নিয়ে বড়লাটের কাছে দরবার করেছিলেন এই কন্যার মুক্তির ব্যাপারে। চিঠি লিখেছিলেন গান্ধীজী। যে সে তো নন ইনি, শুধু কমবয়সী আর মেয়ে বলেই না বিচারক প্রাণদণ্ড দিতে দ্বিধা করেছেন! কে এই অগ্নিকন্যা ?


১৯১৩ সালের ২৭ শে জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর গ্রামে কল্পনা দত্তের জন্ম। তাঁর বাবা বিনোদবিহারী দত্ত ও মা শোভনবালা দত্ত। কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি। ইংরেজ সরকার তাঁর ব্যক্তিত্বকে সম্মান দিত। ফলে তাঁদের বাড়ি বরাবরই পুলিশের নজরের বাইরে ছিল। শৈশব থেকেই কল্পনা মানসিক দিক থেকে ব্যতিক্রমী ছিলেন।  বিপ্লবী দলের তৎকালীন নেতারা মনে করতেন স্বভাবে দরদি ও কোমল মেয়েরা বিপ্লবী কাজে অনুপযুক্ত। ছেলেমেয়ে পাশাপাশি থাকলে ছেলেদের নৈতিক আদর্শ খারাপ হতে পারে। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, ‘It was an iron rule for the revolutionaries that they should keep aloof from the women.’ তিনি বলেই থেমে থাকেননি। সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন যারা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত। বোমা পিস্তল নিয়ে কাজ করার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তাঁরা।

পড়াশোনায় মেধাবী কল্পনা চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হন। তারপর চলে যান কলকাতায়। ভর্তি হন বেথুন কলেজে বিজ্ঞান শাখায়। সেখানে পড়ার সময়ই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগে তাঁর মনে। স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে রোজ সকালে কলেজ কম্পাউন্ডে ঘুরপাক খাওয়া, প্রতি রোববার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন তিনি। 

যোগ দেন কল্যাণী দাসের ‘ছাত্রী সংঘে’। বেথুন কলেজে হরতাল ও অন্যান্য আন্দোলনে অংশ নিতে থাকেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা সূর্যসেনের অনুগামী পূর্ণেন্দু দস্তিদার কল্পনার মতো একজন বিপ্লবীমনস্ক নারীকে পেয়ে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এভাবেই বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ১৯৩০ সালের ১৮ ই এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়। এরপরেই কল্পনা ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিপ্লবী কাজে। চলে আসেন চট্টগ্রামে। বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের মারফত সূর্যসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হন। ১৯৩১ সালের মে মাসে কল্পনার সঙ্গে মাস্টারদার সাক্ষাৎ হয়।

১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। চট্টগ্রামের আদালত চত্ত্বর ভিড়ে ঠাসা। আজ লোকনাথ বল, অনন্ত সিং দের আদালতে হাজিরার দিন। চট্টগ্রাম জেল থেকে বেরুলো প্রিজন ভ্যান। কর্তাদের কাছে খবর গেলো আজ হামলার ছক করছে বিপ্লবীরা। পুলিশ প্রত্যেকটা লোককে সতর্ক ভাবে পরখ করছে। ভিড়ের মধ্যে দেখা গেলো এক মুসলিম মহিলা বোরখা পরে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাদের মধ্যে নজর কাড়ছে তার উচ্চতা। সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর গেলো মহিলা ফোর্স পাঠানোর। অত্যন্ত গোপনে মহিলা পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলল এলাকা। চোখের নিমেষে উধাও সেই মহিলা। আদালতের গেটেও বাহিনী ছিল,কিন্তু কোথা দিয়ে কেমন ভাবে পালালো বোঝাই গেলো না। একটু আগে যে শীর্ণ বৃদ্ধা ঘোমটা দিয়ে লাঠি ঠুকে ঠুকে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো, তিনিই কল্পনা। পুলিশ আবার মিস করলো তাকে। কিন্তু আদালত চত্ত্বর থেকে যা পেলো তা ঘুম উড়িয়ে দিলো পুলিশের। মারাত্মক বিস্ফোরক গান কটন পেলো তারা। কার্পাস তুলোর ওপর নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রন দ্বারা তৈরি এই গান কটন ডিনামাইটের মতো কাজ করে। বিপ্লবীদের প্ল্যান ছিল এই গান কটন দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বন্দিদের মুক্ত করা। আর এর গুরু দ্বায়িত্ব পড়েছিল কল্পনার কাঁধে। সতর্ক পুলিশ জেলের মধ্যে থেকেও উদ্ধার করলো ওই বিস্ফোরক। যে পদার্থের ভয়ে বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ,ফ্রেঞ্চ আর্মি কেঁপে যেতো, সেই পদার্থ পোশাকের মধ্যে করে জেলে সরবরাহ করেছে এই দামাল মেয়ে। ভাবা যায়!!

পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য কল্পনা দত্তের ওপর দায়িত্ব দেন মাস্টারদা। কিন্তু ক্লাবে ছদ্মবেশে রেইকি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান কল্পনা। প্রমাণের অভাবে দুমাস পরে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপন করেন। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামকে সামরিক এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়। প্রতি গ্রামেই ছিল সামরিক ক্যাম্প। আত্মগোপনে থাকা অত্যন্ত কঠিন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা ধরা পড়েন। কল্পনা পুলিশের ব্যূহ থেকে পালিয়ে আসেন। প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করতে করতে কল্পনা দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদার, মনোরঞ্জন দত্ত, মনোরঞ্জন দে ও অর্ধেন্দু গুহ সমুদ্রের ধারে গহিরা গ্রামে আশ্রয় নেন। ১৯৩৩ সালের ১৯ শে মে  গ্রাম ঘিরে ফেলে ব্রিটিশ সেনা। লড়াইয়ে বিপ্লবী মনোরঞ্জন দত্ত, পূর্ণ তালুকদার ও তাঁর ভাই নিশি তালুকদার নিহত হন। গুলি ফুরিয়ে গেলে সবাই গ্রেপ্তার হন। বিপ্লবীদের সাথে কল্পনা দত্তকেও হাতকড়া দিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়।

এই মামলার নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি কেস’। এর চার্জ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন, হত্যা প্রভৃতি। এই মামলার আসামি ছিলেন সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্ত। মামলার রায়ে সূর্যসেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন দীপান্তরের আদেশ হয়। অনেক চেষ্টার পর সেই দীপান্তরের আদেশ স্থগিত হয়। মামলার রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জর্জ বলেন, ‘মেয়ে বলে এবং বয়স কম বলেই কল্পনা দত্তকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা গেল না।’

‘শাস্তি পাওয়ার পরই হিজলি স্পেশাল জেলে কল্পনাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন-চার বছর পর সব নারী রাজবন্দীদের একত্রে আলিপুর জেলে রাখার ব্যবস্থা হয়। সেখানেই শুনলেন কার্ল মার্কসের কথা, পড়লেন জায়াড-এর লেখা, কোলের লেখা বার্নার্ড শ-এর স্যোশালিজম। কমিউনিজম সম্বন্ধে কিছু কিছু বইও তাঁদের কাছ থেকে পেলেন। বইগুলোর যুক্তিতর্ক মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় কল্পনাকে। তিনি দেখলেন, ‘কমিউনিজমের সঙ্গে বিপ্লবীদের মতের কোনো অমিল নেই। কেউ কেউ যখন বলত টেররিস্টদের কমিউনিস্টরা শত্রু বলে মনে করে, হেসে উড়িয়ে দিতেন কল্পনা। দু দলের আদর্শ যখন স্বাধীনতা—তখন পার্থক্য কোথায়?’

১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে কল্পনার বাবা জেলে এলেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। এসে শুনলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কল্পনার বাবাকে লেখা একটি চিঠিতে জানালেন, ‘তোমার মেয়ের জন্য যা যা আমার করার সাধ্য, তা করেছি। তার শেষ ফল জানবার সময় এখনো হয়নি, আশা করি চেষ্টা ব্যর্থ হবে না।’

কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার সাত দিন পরই কল্পনা চলে আসেন চট্টগ্রামে। কমিউনিস্টদের সঙ্গেই কাজ করতে শুরু করেন। সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কুলিদের পড়াতেন; মালিপাড়া, ধোপাপাড়ায় গিয়ে গোপন সভা করতেন। 

১৯৪০ সালে কল্পনা কলকাতায় যান বিএ পরীক্ষা দিতে। জুলাই মাসে বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কল্পনাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে অন্তরীণে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামে। সরকারের তৈরি করা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের (পঞ্চাশের মন্বন্তর) সময় কল্পনার নেতৃত্বে মহিলা সমিতি কাহার সম্প্রদায়ের বিপর্যস্ত মানুষদের সংগঠিত করেছিলেন। এই সময়েই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেন। বছরের শেষে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে অংশ নেন চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে। সেখানেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পূরণ চাঁদ যোশীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম মহিলা আসনে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কল্পনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কংগ্রেসের প্রার্থী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তার বিরুদ্ধে। নির্বাচনী সমাবেশে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি দেখে কংগ্রেস ভয় পেয়ে যায় এবং খোদ জহরলাল নেহেরুকে নির্বাচনী প্রচারে আসতে হয়েছিল। প্রচারে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধিতা করলেও কল্পনার বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করেননি। উপরন্তু ‘বাহাদুর লড়কী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। নির্বাচনে কল্পনা পরাজিত হন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর জন্মভূমি ছেড়ে চলে যান ভারতে। কমিউনিস্ট পার্টির কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। রুশ ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের তথ্য সংগ্রাহক হিসেবে যোগ দেন। মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রনে স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন দুবার ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে। 

ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল কল্পনার। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলো গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম যুব আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিলেন; শেষ করতে পারেননি। আরও একটি মনোবেদনা নিয়ে চলে গেছেন—তাঁর জীবনের স্মৃতিকথার তিন হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলেছিলেন। দিল্লিতে অটোরিকশায় ভুল করে ফেলে নেমে যান, আর ফিরে পাননি।

১৯৯৫ সালের ৮ ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানী মেমোরিয়াল হাসপাতালে কল্পনা দত্ত যোশীর ৮২ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত যোশী একটি চিরস্মরণীয় নাম। ‌

No comments