Header Ads

অচেনা মুখ, অজানা মানুষ


১৮ই এপ্রিল ১৯৩০,মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে তিয়াত্তর জন যুবক চরম আঘাত হানে ব্রিটিশদের ওপর। চারদিনের জন্য হলেও স্বাধীন হয়েছিল গোটা শহর।প্রান বাঁচাতে শ্বেতাঙ্গ রাজপুরুষরা সেদিন জাহাজে চড়ে পালিয়েছিল মাঝ সমুদ্রে। আর সে কারণেই “চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ”কে শাসকেরা জনতার সামনে “অস্ত্রাগার লুণ্ঠন” হিসেবে প্রচার করেছিল। এতে একদিকে যেমন এই অভূতপূর্ব বিপ্লবকে ভারতবাসীর থেকে আড়াল করা হলো আবার ব্রিটিশ ইগোতেও আঘাত লাগলো না। পরবর্তী সময়ে বিপ্লবীদের এবং তাদের পরিবার পরিজনদের ওপর নেমে আসে এক ভয়াল ও নির্মম পুলিশী নির্যাতন। শুধু তাই নয় ভবিষ্যৎ আন্দোলনের কোমর ভাঙতে গ্রহণ করা হয় ডিভাইড এন্ড রুল নীতি।


জেলা শাসক ক্যামেরন চট্টগ্রাম শহরের মুসলমান নেতাদের সাথে বৈঠক করার পর প্রশাসনের উস্কানিতে শহরে হিন্দুদের দোকানপাট ও বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের চেষ্টা হয়। পরিকল্পনা করা হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর। কিন্তু মুসলিম নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে চেয়ারম্যান নুর আহমেদ ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান বাহাদুর জালালুদ্দীন আহমেদের মতো মানুষদের তৎপরতায় ব্রিটিশদের সে অপচেষ্টা সফল হয়নি। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন সেখানকার শিক্ষিত ও বুদ্বিজীবী মুসলমান সম্প্রদায়।

কথায় আছে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়,সেটাই হয়েছিল চট্টগ্রামে। পুলিশের ডেপুটি সুপার রায়বাহাদুর আহসানুল্লা খানের অত্যাচারে সেদিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের পরিবার ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সাধারণ মানুষ। পলাতক সূর্য সেনের খবর জানার জন্য অত্যাচারের নিত্য নতুন কায়দা বের করতো মনুষ্যরূপী এই জানোয়ার , মেয়েদের সম্ভ্রম হানি করতেও দ্বিধা করতো না।

আত্মগোপনরত সর্বাধিনায়ক সিদ্ধান্ত নিলেন তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার।স্বেচ্ছায় সে দায়িত্ব নিলো এক অনাথ বিধবার কিশোর সন্তান।
৩০ শে আগস্ট,১৯৩১, চট্টগ্রামের নিজাম পল্টন খেলার মাঠ মানুষের ভীড়ে থইথই। কদিন ধরে চলা ফুটবল প্রতিযোগিতার সেদিন ছিল ফাইনাল। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে আসবেন আসাহনুল্লা। যথাসময়ে এলেন তিনি, পুরস্কার দেবার সময় সমর্থকদের বিশৃঙ্খলা, হৈহৈ। সেই সুযোগে এক রোগাটে কিশোর পৌঁছে গেল একদম কাছে, আর কেউ কিছু বোঝার আগেই দ্রাম দ্রাম! গুলি খেয়ে শয়তানটা পড়ে যেতে ওর দশাসই চেহারার বুকের ওপর চেপে বসলো ছেলেটা, তারপর পিস্তলের বাকি গুলি গুলোও চালিয়ে দিলো।

অনায়াসে ভীড়ে হারিয়ে যেতে পারতো, কিন্তু কি করবে ! খোদ মাস্টারদা যে বলেছেন কাজটা যেন হয় হরিপদ, তাই আর কোন রিস্ক নেয়নি !

আজ্ঞে হ্যাঁ, পনেরো বছরের ঐ কিশোরের নাম হরিপদ ভট্টাচার্য্য। তবে কোন পাঠ্য বইতে পাবেন না এ নাম !
ধরা পড়ার পর কী অকথ্য নির্যাতন ঘটেছিল সেই কিশোরের ওপর তা তখনকার পত্রপত্রিকায় ফলাও করে লেখা হয়েছিল। নেহরু তাঁর ‘গ্লিমসেস অব ইন্ডিয়া’ বইতে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। হরিপদর মাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি মনিঅর্ডার করেছিলেন, দু’লাইনের কবিতার মাধ্যমে তাঁর আশীর্বাদ জানিয়ে। পুলিশ হাজার অত্যাচার করেও মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারেনি। আদালতে বিচার শুরু হয়। প্রথমে ফাঁসির আদেশ হলেও অল্প বয়সের কথা বিবেচনা করে জুরিরা দ্বীপান্তরের আদেশের পক্ষে মত দেন। তাঁকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার অন্য বন্দীদের সাথে আন্দামান দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তি পেয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কিন্তু বাষট্টি সালে চীনযুদ্ধের সময়ে মতাদর্শের ফারাক হতে দল ছাড়েন। শিলিগুড়ির ভাড়া বাড়িতে কাটিয়েছেন জীবনের শেষভাগ। বাংলাদেশ সরকার মুজিব জমানায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করেছিল। প্রাথমিক শিক্ষিকা স্ত্রীর সামান্য মাইনে এবং ভাতা দিয়ে কোনরকমে সংসার চলতো। শেষ বয়সে আক্রান্ত হলেন ক্যান্সারে। চিকিৎসার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের, খবরটুকুও নেয়নি রাজ্য সরকার।

১৯৯৩ সালের ৩০শে নভেম্বর দেশবন্ধু নগরের ঐ বাসাবাড়ি থেকেই নীরবে দুনিয়া ছাড়লেন মহান এই বিপ্লবী। যে দেশবাসীর স্বাধীনতার জন্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটিয়েছেন সেলুলার জেলের কালকুঠুরিতে তারা কিন্তু তাঁর স্মৃতিরক্ষার কোনও চেষ্টাই করেলো না। শিলিগুড়ি শহরে তাঁর নামে একটা রাস্তাও নেই। এই প্রজন্মের আজ আর কেউ তাঁকে মনে রাখেনি !‌‌

No comments