Header Ads

কারাগারে চৌত্রিশ বছর ‌


শিরোনামটি দেখে কি ভাবলেন? নিশ্চয়ই নেলসন ম্যান্ডেলার কথা বলবো। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যিনি এক নির্জন দ্বীপে বন্দী ছিলেন। কিন্তু সেতো সাতাশ বছর! তবে কে ইনি ?

চিরকুমার মানুষটি ছিলেন কখনো যোদ্ধা, কখনো গুপ্তচর। ব্রিটিশ সরকারের দায়ের করা একের পর এক মামলায় তাঁকে কারাভোগ করতে হয় দফায় দফায়। কখনো হত্যা মামলা, বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা, ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা, রাজাবাজার বোমা হামলা এভাবে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর কারাগারেই কাটে। ১৯৫৭ সালে তাঁর লেখা বই 'জেলে তিরিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম' প্রকাশিত হয়েছিল। তখনও জানতেন না এরপর আরো চারবছর কাটাতে হবে পাকিস্তানের জেলে।


এ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, 'পৃথিবীতে সম্ভবত আমিই রাজনৈতিক আন্দোলন করার কারণে সর্বাধিক সময় জেলখানায় অতিবাহিত করেছি'। মাঝখানে দু-এক মাস বিরতি ছাড়া আমি টানা ৩০ বছর জেলখানায় কাটিয়েছি। জীবন-যৌবনের ৩০টি বছর কারাগারে কেটে গেলেও তাঁর বিপ্লব ছিল চিরজাগ্রত। জেলে আটকে রেখে তাঁর বিপ্লবী মনোভাবকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। শুধু বিপ্লবীই ছিলেন না, ছিলেন একজন মানবদরদী, দেশপ্রেমিক ও সমাজসংস্কারক। মানুষের জন্য, দেশের জন্য জীবনব্যাপী দুঃসহনীয় অত্যাচার সহ্য করেও তিনি নিজেকে কখনো সফল বিপ্লবী বা সফল মানুষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেননি। আর সেজন্যেই তিনি মহারাজ !

১৮৮৯ সালের মে মাসে ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার শান্ত গ্রাম কাপাসাটিয়ার সাধারণ একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দুর্গাচরণ চক্রবর্তী ও মা প্রসন্নময়ী দেবীর পরিবারে তিনি  ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। বাবা ছোট ছেলেটিকে স্বদেশীয়ানায় অনুপ্রাণিত করেন যাতে ছেলে মনে-প্রাণে দেশ প্রেমিক হতে পারে। প্রাথমিক পড়াশুনা বাড়িতেই, ১৯০৩ সালে তাঁকে সানসাটের পুখুরিয়া মাইনর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। ওই স্কুলে পড়াশুনার সময় তিনি 'অনুশীলন' সমিতির সংস্পর্শে আসেন। এরপর ময়মনসিংহ জিলা হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে  তিনি 'অনুশীলন' সমিতির সাথে সরাসরি যুক্ত হন।  এখানে তিনি পড়াশুনার পরিবর্তে সারাক্ষণ পরিকল্পনা করতেন সশস্ত্র বিপ্লবের। বোমা পিস্তল চালানোর সাথে শুরু করলেন রাজনীতি নিয়ে পড়াশুনা । নিজের জেলায় তৈরি করলেন বিপ্লবী ঘাঁটি । ম্যাট্রিক পরীক্ষার দুমাস আগে ১৯০৮ সালে দলের কাজে নারায়নগঞ্জে এলে, ব্রিটিশ পুলিশ বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করে ছয় মাসের জেল দেয়। ওখানেই তাঁর প্রথাগত শিক্ষার সমাপ্তি, শুরু হয় এক নতুন জীবন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন।

এখানে আসার পর তাঁকে ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন ঢাকা পুলিশ সুপার লোম্যান। কিছু মনে পড়লো নাকি ? যাইহোক সহযোদ্ধাদের পরামর্শে তিনি আত্মগোপন করেন  আগরতলার উদয়পুর পাহাড় অঞ্চলে। সেখানে গিয়েও তিনি বিপ্লবী দলের একটি শাখা স্থাপন করেন। দুই বছরের মধ্যে উদয়পুর পাহাড় অঞ্চলে বিপ্লবীদের একটি বিশাল ঘাঁটি তৈরি হয়। তাঁর কাজ ছিল শরীর চর্চা, ব্যায়াম, লাঠি খেলা, ছোরা খেলা, কুস্তি ইত্যাদির আড়ালে রাজনৈতিক শিক্ষা, বিপ্লবাত্মক প্রচার ও বিপ্লবী কর্মী তৈরী করা। উদ্দেশ্য একটাই, দেশমাতৃকাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করা। পলাতক জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে মহারাজ লিখেছেন, ‘পান্তাভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিন বছর পর বাড়ি ফিরি। মাত্র দশ দিন বাড়ি থাকার পর আবার শুরু সুদীর্ঘ পলাতক জীবন। তিন পয়সার ছোলা খেয়ে পঁচাশি মাইল পথ হেঁটে নিরাপদ আশ্রয় পাই।’ ১৯১২ সালে ওখান থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও প্রমাণের অভাবে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়। এরপর তিনি আসেন মালদহে। এখানে দলের একটি শক্তিশালী শাখা গঠন করার পর ১৯১৩-১৯১৪ সালে তিনি রাজশাহী ও কুমিল্লায় গুপ্ত বিপ্লবী দলের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৪ সালে পুলিশ তাঁকে কলকাতায় গ্রেপ্তার করে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে আন্দামানে পাঠায়। সেলুলার জেলে ছিলেন দশ বছর। ১৯২৪ সালে মুক্তি পেয়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পরামর্শে দক্ষিণ কলকাতা জাতীয় বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে ফের গ্রেপ্তার হয়ে বার্মার মান্দালয় জেলে বন্দী হন। সেখানে তাঁর সহবন্দী ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র।

১৯২৮ সালে তাঁকে ভারতে এনে হাতিয়া দ্বীপে অন্তরীণ করে রাখা হয়। মুক্তি পেয়ে তিনি উত্তর ভারতে চলে যান এবং বিসমিল ও চন্দ্রশেখর আজাদের সাথে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দেন। বার্মার বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে একসময়ে বার্মায় যান। ১৯২৯ সালে যোগ দেন লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে। ১৯৩০ সালে আবারও গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৩৮ সালে মুক্তি পান। সুভাষচন্দ্রের পরামর্শে এরপর রামগড় কংগ্রেসের কাজে যুক্ত হন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটানোর চেষ্টা করেন। ১৯৪২ সালে তিনি 'ভারত-ছাড়ো' আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হন। ১৯৪৬ সালে মুক্তি পেয়ে নোয়াখালীতে সংগঠন গড়ার চেষ্টা করেন। 

দেশভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান এবং রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। 

হিন্দুরা যেন দেশত্যাগ না করে, সে বিষয়ে জেলায় জেলায় গিয়ে প্রচার চালান। পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁর এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভালো চোখে দেখেনি। তাঁর লেখা জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারত স্বাধীনতা সংগ্রাম বইটি ওদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। 

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়, বাতিল হয়ে যায় তাঁর সদস্য পদ। ১৯৬৫ তে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় দেশপ্রেমিক মানুষটিকে পাকিস্তান সরকার আবার দুই বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে। বিপ্লবী মানুষটি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় কারা কর্তৃপক্ষ  মৃত্যুর আশঙ্কা করে তড়িঘড়ি মুক্তি দেয় তাঁকে।

এরপর উনি নিজের গ্রাম ময়মনসিংহের কাপাসাটিয়ায় চলে যান এবং সেখানে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত একরকম নির্জনবাস করেন। চিকিৎসার জন্য অনুগামীরা তাঁকে ভারতে নিয়ে যেতে চাইলেও পাক সরকারের অনুমতি মেলেনা। শেষমেশ জনতার চাপ আর ভারত সরকারের আগ্রহে তিন মাসের জন্য পাসপোর্ট মঞ্জুর হয়। ১৯৭০ সালের ২৪ জুন তিনি ভোরবেলা বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সাদরে অভ্যর্থনা জানানো হয় তাঁকে, কিন্তু মাতৃভূমিতে আর তাঁর ফেরা হয়না। ওই বছর ৯ই আগষ্ট কলকাতায় মারা যান চিরকুমার ও আজীবন বিপ্লবী মানুষটি, সাত্বিক জীবন যাপনের জন্য অনুগামীরা যাকে মহারাজ বলতো। তিনি ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী,স্বপ্ন দেখেছিলেন এক ধর্ম নিরপেক্ষ ও ঐক্যবদ্ধ ভারত পাকিস্তানের। সীমান্তের দুপাড়েই আজ আর কেউ তাঁকে মনে রাখেনি !

No comments