Header Ads

"There shall be no Appeal!" ফাঁসির আদেশ শুনে এই উত্তর দিয়েছিলেন কানাইলাল দত্ত


 আচ্ছা মাস্টারমশাই আপনি আমার চরিত্রে কি কি দোষ দেখতে পান ?

- তোমার সব ভাল। But You are a bit too shy !

স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত থাকার দরুণ মাস্টারমশাই চারুচন্দ্র রায় নিজেও কিছুদিন আলিপুর জেলে বন্দি ছিলেন। আলিপুর জেলে যিনি কানাইলালের ওয়ার্ডার ছিলেন তিনিই কানাইয়ের ফাঁসির কার্য সম্পাদকের ভূমিকাও নিয়েছিলেন। প্রিয় ছাত্র কানাই সম্পর্কে তিনি চারুচন্দ্র রায়কে বলেছিলেন,  "I am the sinner who has executed Kanailal. If you have a hundred men like him, your aim will be fulfilled." চারুবাবু অবাক হয়ে যান পুরোনো দিনের কথা ভেবে। এই ছাত্রটিকে তিনি একসময় বলেছিলেন , You are a bit too shy !

১৯০৮ সালের ৩১ শে আগস্ট। ঘড়ির কাঁটায় সকাল পৌনে সাতটা। কোমরে গোঁজা রিভলভার থেকে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় রাজসাক্ষী হতে চাওয়া বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে লক্ষ্য করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালিয়ে দিয়েছেন সত্যেন-কানাই।

একটু দূরেই ছিল ডিসপেনসারি। রক্তাক্ত নরেন ছুটতে শুরু করলেন সে দিকে, কাতর আর্তনাদ শোনা গেল, "বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে!" আহত অবস্থাতেই নরেন ছুটলেন জেল গেটের দিকে। রিভলভার হাতে পিছনে দৌড়লেন সত্যেন-কানাই। 


কানাই নরেনের কাছে ছুটে এসে আবার গুলি চালাল। একেবারে অব্যর্থ লক্ষ্য। গুলি কোমরের কাছে শিরদাঁড়া ভেদ করে চলে গেলো। সামনের নালায় মুখ থুবড়ে পড়লো নরেন। তাকিয়ে দেখলেন, নরেন মুখ থুবড়ে পড়ছেন জেলের রাস্তা-সংলগ্ন ড্রেনে। কানাই রিভলবার খুলে দেখে নিল মাত্র একটা গুলি রয়েছে। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়া নরেনের মাথায় শেষ গুলিটা করলো কানাই। সেদিন নরেনের শরীরে বিঁধেছিল মোট নয়টি বুলেট। 

নরেন গোঁসাইকে খুন করেও নিরুত্তাপ ছিলেন কানাই। মুখে হাসি লেগেই থাকত সর্বদা। বিচারপর্বে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল -
- Why did you shoot the last bullet on the head of Naren Gosai when you know that he is already dead?

- So far all our attempts had been foiled and the enemy did narrowly escape. I wanted to be sure of the result. I am simply disgusted with attempts, attempts and attempts!

বিচারে ফাঁসির আদেশ হয়েছিল কানাইয়ের। মৃত্যুদন্ড রদের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করবেন কিনা জানতে চাওয়া হলে কানাই বলেছিলেন, "There shall be no Appeal !" আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এই কথা শুনে বলেছিলেন - কানাই শিখিয়ে গেল হে। Shall আর Will ব্যবহারের পার্থক্য কিভাবে কোথায় করতে হয় কানাই বাঙালি জাতিকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে গেল।

ফাঁসির আদেশ পাওয়ার পরে আলিপুর জেলে পাশাপাশি সেলে ফাঁসির প্রতীক্ষায় দিন গুনছে কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সত্যেন ব্রাহ্ম। সত্যেনের ইচ্ছে মৃত্যুর আগে একবার সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের কর্ণধার পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে তাঁর কাছ থেকে আশীর্বাদ চাইবেন। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি মিললো। পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী জেলে ঢুকে সত্যেনকে আশীর্বাদ করে গেলেন। 

কানাইয়ের এক পরিচিত শিবনাথ শাস্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কানাইকে দেখেছেন কিনা। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন - " কানাইকে দেখলাম, সে পায়চারি করছে - যেন পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহ ! বহু যুগ তপস্যা করলে তবে যদি কেউ তাকে আশীর্বাদ করার যোগ্যতা লাভ করতে পারে।"

মুখে সর্বদা হাসি লেগেই থাকত। ফাঁসির আগেরদিন ওয়ার্ডার তাঁকে বিদ্রুপের সুরে একবার বলেছিলেন, "You are smiling now, but tomorrow morning all the smiles will disappear from your lips." 
সেদিন কানাই শুধুই হেসেছিলেন। 

১৯০৮ সালের ১০ই নভেম্বর। ভোর পাঁচটা। আলিপুর জেলে সেদিন প্রায় উপস্থিত পুলিশ কমিশনার মিস্টার হ্যালিডে, ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার বোমপাস। উপস্থিত ৩০০ সশস্ত্র উর্দিধারী। জেলের ঘড়িতে তখন সকাল ছয়টা। কিছু কারারক্ষী কানাইয়ের জেলের দরজা খুলে তাঁকে নিয়ে আসলেন। মুখে সেদিনও হাসি লেগেই আছে। চোখে উজ্জ্বল দ্যুতি। হাত পিছনে বাঁধা। কানাইকে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগোলেন পুলিশ কমিশনার মিস্টার হ্যালিডে, ডেপুটি পুলিশ কমিশনার, আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার বোমপাস।

ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগোতেই কানাইয়ের চোখে পড়ল সেই ওয়ার্ডার। কানাই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন ওয়ার্ডারকে লক্ষ্য করে - "How do you find me now?" 

সেদিন আর ওয়ার্ডার কোন জবাব দিতে পারেননি।

বীরদর্পে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন কানাই। গলায় পরানো হল ফাঁসির রজ্জু। জল্লাদকে লক্ষ্য করে কানাই বললেন-"দড়ি বড় কড়া হয়েছে। গলায় লাগছে।"

দড়ি খুলে আবার গলায় লাগানো হল। মুখ ঢেকে দেওয়া হল কালো কাপড়ে। 

ফাঁসির পাটাতন সরে গেল। নীচে নেমে গেল কানাইয়ের দেহ। ফাঁসির রজ্জু কিছুক্ষন কাঁপল। তারপর স্থির হয়ে গেল। অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন কানাই।

কানাইয়ের দেহ সেদিন জেল থেকে আনতে গিয়েছিলেন দাদা আশুতোষ দত্ত এবং সতীর্থ মতিলাল রায়। মতিলাল রায় কানাইয়ের মৃতদেহ দেখে বলেছিলেন (বইতে লিখেছেন), "As soon as the blanket was carefully removed, what did we see - language is wanting to describe the lovely beauty of the ascetic Kanai - his long hair fell in a mass on his broad forehead, the half-closed eyes were still drowsy as though from a test of nectar, the living lines of resolution were manifest in the firmly closed lips, the hands reaching to the knees were closed in fists. It was wonderful! Nowhere on Kanai's limbs did we find any ugly wrinkle showing the pain of death.."

সে দিন তাঁর শবদেহ নিয়ে কলকাতা শহরের বুকে এক জনপ্লাবনের সাক্ষী থেকেছে পুলিশ। লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে এক বারের জন্য হলেও শববাহী খাটটি ছুঁতে চায়। সর্বত্র ‘জয় কানাই’ ধ্বনিতে আন্দোলিত। কেওড়াতলা শ্মশানে দাহকার্যের পর কানাইলালের ‘চিতাভস্ম’ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়। আধ ছটাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। পুলিশের পদস্থ কর্মচারী এফ সি ড্যালির বক্তব্য: “কানাইলাল দত্তের চিতাভস্ম বলে কলকাতায় যা বিক্রি হয়েছিল, অনুমান করা হচ্ছে তা চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ গুণ বেশি!”

কানাই সম্পর্কে লিখতে গেলে আজ ১০০ পাতার উপর অনায়াসেই লিখে ফেলা যায়। সেই লেখা অন্য কোন দিন অন্য কোন মাধ্যমে প্রকাশ পাবে এই কামনা করি। অমর শহীদ চন্দননগর তথা বাংলার চিরগর্ব কানাইলাল দত্তকে রইল শ্রদ্ধার্ঘ্য।


No comments