Header Ads

বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা বাঙালি কবি, নারীবাদী লেখিকা কামিনী রায়


'ত্রিদিবে দেবতা নাও যদি থাকে ধরায় দেবতা চাহি গো চাহি,
মানব সবাই নয় গো মানব, কেহ বা দৈত্য, কেহ বা দানব,
উৎপীড়ন করে দুর্বল নরে, তাদের তরে যে ভরসা নাহি—
ধরায় দেবের প্রতিষ্ঠা চাহি।’

এই কঠিন কিন্তু মর্মভেদী কথাগুলোর স্রষ্টা বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা বাঙালি কবি, নারীবাদী লেখিকা কামিনী রায় (সেন)। আজ তার জন্মদিন। ১৮৬৪ সালের ১২ ই অক্টোবর আজকের দিনেই বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের বাসন্ডা গ্রামে কবি কামিনী রায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম চন্ডীচরণ সেন এবং মাতার নাম বামাসুন্দরী দেবী। চণ্ডীচরণ সেন একজন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক ছিলেন। ১৮৭০ খ্রীস্টাব্দে চণ্ডীচরণ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। পরের বছর তার স্ত্রী-কন্যাও কলকাতায় তাঁর কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁর ভগিনী যামিনী সেন চিকিৎসক হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। 


কামিনী রায়ের পড়াশুনার হাতেখড়ি তার মায়ের কাছে। বাড়ীতেই তিনি বর্ণপরিচয় ১ম ও ২য় ভাগ এবং শিশুশিক্ষা শেষ করে ৯ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন এবং ঐ বছরই আপার প্রাইমারী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৪ বছর বয়সে তিনি মাইনর পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কামিনী রায় ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বেথুন ফিমেল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষা ও ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই বেথুন কলেজ থেকে তিনি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী হিসেবে সংস্কৃত ভাষায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি বেথুন কলেজেই শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

শৈশবে কামিনী রায়কে তাঁর পিতামহ কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি করতে শেখাতেন। এভাবেই খুব কম বয়স থেকেই কামিনী রায় সাহিত্য রচনা করেন ও কবিত্ব-শক্তির স্ফূরণ ঘটান। তাঁর জননীও তাকে গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। কারণ তখনকার যুগে হিন্দু পুরমহিলাগণের লেখাপড়া শিক্ষা করাকে একান্তই নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হত। মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর রচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার সহজ-সরল ও সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। পনের বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ আলো ও ছায়া প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ খ্রীস্টাব্দে। এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত ‘আলো ও ছায়া’ কামিনী রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন পাঠক-সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে আছে- ‘নির্মাল্য’ (১৮৯১), ‘মাল্য ও নির্মাল্য’ (১৯১৩), ‘দ্বীপ ও ধূপ’ (১৯২৯), ‘মহাশ্বেতা’, ‘পুন্ডরীক’।

শিশুদের জন্য লিখিত গ্রন্থসমূহ হচ্ছে ‘পৌরাণিকী’ (১৮৯৭), ‘বালিকা শিক্ষার আদর্শ’ (১৯১৮), ‘ঠাকুরমার চিঠি’ (১৯২৪) প্রভৃতি। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে ‘ধর্ম্মপুত্র’ (১৯০৭) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। অম্বা (১৯১৫) তাঁর লেখা জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে অন্যতম। এবং চন্দ্রাতীরের জাগরণ নাট্যকাব্যটি বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত 'মহাশ্বেতা' ও 'পুণ্ডরীক' তার দুটি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও, ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য 'গুঞ্জন' নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন।

১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে কামিনী রায়ের সাথে কেদারনাথ রায়ের বিয়ে হয়। তাদের তিনটি সন্তান জন্মায়। প্রথম সন্তানটি জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই (১৯০০ সালের দিকে) মারা যায়। অপর দুই সন্তানের নাম ছিল লীলা রায় ও অশোকরঞ্জন রায়। ১৯০৩ সালে কামিনী রায়ের বোন কুসুম, ১৯০৬ সালে প্রথমে ভাই ও পরে বাবা মারা যায়। ১৯০৮ সালে তার স্বামী কেদারনাথ রায় ঘোড়ার গাড়ী উল্টে গিয়ে আঘাত পেয়ে় মারা যান এবং এর কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সন্তান লীলা ও অশোককেও হারান। এভাবে মাত্র ৭ বছরের মধ্যে প্রায় সকল আপনজনকে হারিয়ে তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েন।

স্বামী-সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের অকাল-মৃত্যুর ফলে তার সাহিত্যের মধ্যে একধরণের ব্যাথ্যাতুর ও নৈসর্গপ্রিয়তার ভাব লক্ষ্যনীয়। ব্যক্তিগত বেদনা, দেশ প্রেম, জীবন চিন্তার নানাভাব বিভিন্ন রূপকল্পনা ও প্রতিমার মধ্য দিয়ে তাঁর কাব্যে নতুন রূপে প্রকাশ করেছেন; তার লেখায় মানবতাবোধ এবং নৈতিকতা প্রকাশই মূখ্য হয়ে দেখা দেয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি রবীন্দ্র মন ও মানস দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন। আবার সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভের কারণে তার সাহিত্য-রচনাগুলো বিশেষভাবে সংস্কৃত অলংকরণ ও ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত।

তৎকালীন সময়ে মেয়েদের শিক্ষাও বিরল ঘটনা ছিল, সেই সময়ে কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। লিখেছিলেন সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ও নারী জাগরণের পক্ষে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষতঃ করে নারী কল্যাণে তার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। সেসময়ে মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থাও এক বিরল ঘটনা ছিল, এবং কামিনী রায় হয়ে উঠেছিলেন নারীবাদে বিশ্বাসী। লিখেছেন সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ও নারী জাগরনের পক্ষে। তিনি ১৯২৩ এক সম্মেলণে বরিশাল আসলে কবি বেগম সুফিয়া কামালের সাথে পরিচিত হয়ে তাকে লেখালেখির বিষয়ে প্রবল উৎসাহ দেন এবং মনোনিবেশ করতে বলেন। তিনি ১৯২২-২৩ সালে নারী শ্রম তদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নারী জাগরণে আসামান্য অবদান এবং তৎকালীন পশ্চাদপদ সমাজের মধ্যে থেকেও প্রথম স্নাতক সম্মান ডিগ্রী অর্জন করায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবি কামিনী রায়ের স্মরণে ১৯২৯ সাল থেকে ‘জগত্তারিনী পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছে। তিনি ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি ও ১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

শেষ জীবনে তিনি ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের হাজারীবাগ বসবাস করতেন এবং ১৯৩৩ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর সেখানেইে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর একটি লেখা আজও আমাদের পথ চলার পাথেয়-

'সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।'

তথ্য - উইকিপিডিয়া, দেশ বিদেশে পোর্টাল

No comments