Header Ads

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ ও তার সংগ্রামী জীবন

সালটা ১৯২১।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছাত্রীদের পড়ার অধিকার ছিল না।এদিকে অসম্ভব মেধাবী এক ছাত্রী জেদ ধরলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই এম.এ. পড়বেন।১৯১৯ সালে ২০ টাকা বৃত্তি পেয়ে আইএ পাশ করেন তিনি।এরপর ১৯২১ সালে বেথুন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন।বি.এ পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পদ্মাবতী’ স্বর্ণপদক লাভ করেন।


কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছাত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।উপায়?

ছাত্রীর জেদতিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বেন।মেয়েরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে না এই মর্মে তিনি চ্যান্সেলর (বাংলার গভর্ণর) ও ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে দেখা করে নিজের কেস প্লীড করেন।তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর পি জে হার্টজ তাঁর মেধা ও আকাঙ্খা বিবেচনা করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন।তার ভর্তি ক্রমিক নাম্বার ছিল ২৫।এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব লীলা নাগ।

উপমহাদেশে নারী জাগরণের পথিকৃৎ লীলা নাগ আসামের গোয়ালপাড়ায় ১৯০০ সালের ২রা অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন।জন্মগত নাম শ্রীমতি লীলাবতী নাগ।মা-বাবা আদর করে ডাকতেন বুড়ি।পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট।মা কুঞ্জলতা ছিলেন গৃহিনী।লীলার বাবার বাড়ি ছিল মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরেপাঁচগাঁওতে।তাদের পরিবার ছিল মৌলভীবাজারের অন্যতম শিক্ষিত ও সংস্কৃতমনা একটি পরিবার।১৯১৬ সালে বাবা অবসরগ্রহণ করার পর তিনি স্থায়ীভাবে বাস করার জন্যে আসাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন।

১৯০৫ সালে আসামের দেওগড় বিদ্যালয়ে লীলার শিক্ষাজীবন শুরু হয়।সেখানে দুবছর অধ্যয়নের পর ভর্তি হন কলকাতার ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে। ১৯১১ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকার ইডেন হাইস্কুলে।১৯১৭ সালে সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্যে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। পড়াশোনায় তার গভীর আগ্রহ ছিল।খেলাধুলাতেও উৎসাহ কম ছিল না।নিয়মিত টেনিসব্যাডমিন্টন ও হাডুডু খেলতেন লীলা।শিক্ষকদের কাছে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লীলা ছিলেন প্রিয় ছাত্রী।

শিক্ষা জীবন থেকেই তার মধ্যে বিপ্লবী চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল।কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়ে বড়লাটের পত্নীকে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানানোর প্রথা বাতিলের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।ছিলেন অসম্ভব মেধাবী।আইএ পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিলেন।বি.এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন।এম.এ. পড়তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেই শিক্ষাবর্ষে (১৯২১-২২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে বি.এ (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হন আরেকজন ছাত্রীসুষমা সেনগুপ্ত।সুষমা সেনগুপ্তের নিজস্ব স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, “আইএ পড়তে পড়তে আমার বিয়ে হয়ে গেলো।ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হলো।বি.এ পড়তে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।সে বছর লীলাও এম.এ ক্লাসে ভর্তি হলো।ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমরা দুজন প্রথম ছাত্রী।এক কমন রুমে বসতাম দুজন।ক্লাসে যাবার সময় অধ্যাপক আমাদের ডেকে নিয়ে যেতেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাবস্থাতেই লীলা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরআচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও ঋষি রামানন্দের সাহচর্য লাভ করেন।১৯২৩ সালে তিনি ইংরেজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এম.এ ডিগ্রিধারী।শিক্ষাজীবন শেষ করে লীলা নারীশিক্ষার প্রসার ও স্বদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে ব্রতী হন।নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যে ১২ জন সংগ্রামী সাথী নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন দীপালি সংঘ।এই সংঘের মাধ্যমে তিনি দীপালি স্কুল ও আরও ১২টি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষাভবন নামেও দুটি স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

ঢাকায় তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল দীপালি-১ পরবর্তীতে নাম বদলে হয় কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলআর নারীশিক্ষা মন্দির নাম হয় শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়।ঢাকার আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।বিয়ের পর লীলা কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এছাড়াও তিনি দীপালি ছাত্রী সংঘ ও মহিলা আত্মরক্ষা কেন্দ্রও গড়ে তোলেন।বিপ্লবী পুলিন দাসের নেতৃত্বে মেয়েরা এখানে অস্ত্র চালনা ও লাঠিখেলা শিখতেন।
দীপালি সংঘ তৈরির আগে থেকেই লীলা বিপ্লবীদের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস ও বাংলার অন্যান্য বিপ্লবী দলগুলো সুভাষচন্দ্র বসুর চারপাশে সমবেত হতে থাকে।স্বামী অনিল রায়আরেক বিপ্লবীকে নিয়ে লীলাও উপস্থিত হন সেখানে।নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনে বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস বলার সময় লীলা মঞ্চে ওঠেন।তার বিপ্লবী জীবনের পথ এর মাধ্যমে প্রশস্ত হয়।নেতাজির অনুরোধে তার প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ফরওয়ার্ড ব্লকের সম্পাদনার ভার নেন লীলা।

পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে দীপালি সংঘের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে থাকে।দলে দলে মেয়েরা এর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে।আসাম ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে এর শাখা বিস্তৃত হতে থাকে।নারী সমাজের মুখপাত্র হিসেবে জয়শ্রী’ নামে একটি পত্রিকাও বের করেন তিনি।ছাত্রীদের সুবিধার জন্যে কলকাতায় একটি মহিলা হোস্টেল তৈরি করান তিনি।বিপ্লবী নেত্রী লীলা নাগের কাছে দলের ছেলেরাও আসতেন নানা আলোচনার উন্মুখতা নিয়ে।প্রীতিলতার মতো সুপরিচিত নারী বিপ্লবীরাও এই দীপালি সংঘের মাধ্যমেই বিপ্লবের পাঠ নিয়েছিলেন লীলা নাগের কাছ থেকে।দীপালি সংঘ ছাড়াও অনিল রায়ের শ্রীসংঘের সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালে সব বিপ্লবী দলের নেতাদের ইংরেজ সরকার একযোগে গ্রেফতার করা শুরু করলে অনিল রায়ও গ্রেফতার হন।ফলে শ্রীসংঘের দায়িত্ব পুরোটাই এসে পড়ে লীলার উপর।
শ্রীসংঘের সদস্যরা সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে অস্ত্র সংগ্রহ ও বোমা তৈরির কাজ করতেন।বোমার ফর্মুলা নিয়ে কাজ করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র অনিল দাস ও শৈলেশ রায়।১৯৩১ সালে বিপ্লবীদের কার্যকলাপ আরও জোরদার হয়।পরপর বেশ কিছু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা জজ বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন।এর মধ্যে কুমিল্লার জেলা জজ স্টিভেন্সের হত্যাকাণ্ডে শান্তি ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরী জড়িত থাকার ফলে পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে।

১৯৩১ সালের ২০শে ডিসেম্বর দীপালি সংঘের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে লীলা নাগকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৩১ সালের ২০শে ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৭ সালের ৭ই অক্টোবর পর্যন্ত লীলা ঢাকারাজশাহীসিউড়ীমেদিনীপুর জেল ও হিজলী বন্দিশালায় আটক ছিলেন।ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক হওয়া প্রথম নারী রাজবন্দী লীলা নাগ।পরবর্তীতে আরও অনেকবার কারাভোগ করতে হয় তাকে।

জেল থেকেই লীলা সাংঠনিক সংহতিকে অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড করে বৈপ্লবিক সংঘাত পরিচালনার প্রয়াস চালান।জেল থেকে মুক্তি পাবার পর পুনরায় লীলা পূর্ণোদ্যামে কাজে নামেন।১৯৪৭ এর দেশভাগের পর অনিল-লীলা দম্পতি পূর্ববঙ্গে বসবাসের উদ্যোগ নেন।পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু রক্ষা ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তারা।এ সময় কবি সুফিয়া কামাল কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলে লীলা নাগ তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ১৯৫১ সালে ভারত সরকার প্রণীত উদ্বাস্তু উচ্ছেদের বিলের বিরোধীতা করে আবারও গ্রেফতার হন লীলা।

১৯৩৯ সালে বিপ্লবী অনিল রায়কে বিয়ে করেন লীলা।বিয়ের পর তার নাম হয় লীলা রায়।১৯৫২ সালে লীলা নাগের স্বামী অনিল রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।বিয়ের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় অকাল বৈধব্য ও বহুদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের সাথীকে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন লীলা।তবে কম সময়ের মধ্যেই শোক কাটিয়ে স্বদেশের বৃহত্তর স্বার্থে পুনরায় মনোনিবেশ করেন তিনি।

১৯৬৪ সালে পূর্ব বাংলা বাঁচাও কমিটির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে পুলিশ লীলা নাগকে গ্রেফতার করে।১৯৬৬ সালে ছাড়া পাবার পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।১৯৬৮ সালের ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাকে কলকাতার পি.পি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।২৩ দিন সংজ্ঞা ফিরে এলেও বন্ধ হয়ে যায় তার বাকশক্তি।শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণরুপে অচল হয়ে যায়।এভাবেই আড়াই বছর চলার পর ১৯৭০ সালের ১১ই জুন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক মহানায়িকাঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীউপমহাদেশের নারী সমাজের জাগরণের প্রথম অগ্রদূতঅগ্নিকন্যা লীলা নাগ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

লীলা নাগদের জন্মই হয় একটি যুগের পরিবর্তন করতেজংধরা একটি সমাজ ব্যবস্থায় বিপ্লব নিয়ে আসতে। নিজেদের সারাটা জীবনের সাধনার দ্বারা এরা উত্তরসূরীদের জন্য রেখে যান উত্তমতর সমাজ ব্যবস্থা আর স্বাধীনতার স্বাদ।তাদের কীর্তিই তাদের করে রাখে অমর।


তথ্য-রোর বাংলা



No comments