এক উপেক্ষিত ভাষা আন্দোলন : মানভূম ভাষা আন্দোলন
বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। সারা পৃথিবীতে স্বীকৃতি রয়েছে আমাদের বাংলা ভাষার। বাংলার মাটিতেই জন্ম নিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল
ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মত প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিকেরা।তাঁরা
বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করেছেন আমাদের বাংলা ভাষাকে।বাংলা ভাষার সাথে জুড়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ।এই আবেগ মায়ের মুখ নিঃসৃত ভাষার প্রতি সন্তানের আবেগের। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রক্তাক্ত রাস্তা সে পরিচিতি এনে দিয়েছে।বরকত, জব্বার, সালামদের রক্তে
রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে
জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।কিন্তু এর পাশাপাশি, মাতৃভাষার জন্য মানভূমের বাঙালিদের দীর্ঘ আন্দোলন নিয়ে যে কোনও রকম আলোচনা থেকে বিরত থাকেন অনেক বাঙালি।অবহেলা না আত্মবিস্মরণ? ভুলে গেলে চলবে না আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলো ভাষা-আন্দোলন হয়েছে
তার মধ্যে দীর্ঘতম ভাষা-আন্দোলন হলো মানভূমের ভাষা-আন্দোলন।এ-আন্দোলন দীর্ঘ
পাঁচ-ছয় বছর স্থায়িত্ব লাভের পর সফলতার মুখ দেখে। এই ইতিহাস বাঙালির গর্বের ইতিহাস।প্রত্যেক বাঙালির এই ইতিহাস সম্পর্কে জানা উচিত।
লর্ড কার্জনের বঙ্গবিচ্ছেদের একটা অংশ যত আলোচিত হয়, ততটাই
উপেক্ষিত দ্বিতীয় অংশটি। বঙ্গবিচ্ছেদ তো কেবল পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গের ভাগ নয়! বঙ্গবিচ্ছেদ আসলে ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ-উত্তরবঙ্গ-অসম-ত্রিপুরা নিয়ে একটি ভাগ আর বাংলার বাকি অংশের সঙ্গে বিহার-ওড়িশা
মিলিয়ে আর একটি ভাগ।মানভূম ছিল দ্বিতীয় অংশে।১৯০৫-এ না হলেও বাস্তবে বঙ্গবিচ্ছেদ ঘটে গেল ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে জাতীয় কংগ্রেসের ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের নীতির বাস্তব রূপায়নের দাবিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিকতা বেড়ে উঠতে শুরু করে।সেই পরিস্থিতিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশের স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তাকে বিবেচনা করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের সুপারিশ করেন এবং সেই হিসেবে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন বা দার কমিশন নিয়োগ করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে্র ডিসেম্বর মাসে কমিশন মত দেয় যে, স্বাধীনতার সাথে সাথে জাতীয় কংগ্রেস তাঁর অতীত অঙ্গীকার থেকে অব্যাহতি পেয়েছে এবং শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন না করে ভারতের ঐক্যবদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এই কমিশনের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়াকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের এক উচ্চপর্যায়ের কমিটি নিয়োজিত হয়।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তৎকালীন বিহার সরকার ঐ রাজ্যের মানুষদের ওপর হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রাথমিক স্তরে ও সরকারি অনুদান যুক্ত বিদ্যালয়ে হিন্দী মাধ্যমে পড়ানোর নির্দেশ আসে, জেলা স্কুলগুলিতে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয় ও হিন্দীকে বিহার রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।অ্যাসেম্বলিতে বাংলা
প্রার্থনাগীতের পরিবর্তে হিন্দীতে ‘রামধুন্’ গাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়।আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে শুধুমাত্র হিন্দীতে শিক্ষা দেয়ার, দাপ্তরিক কাজে বা সরকার বরাবর কোন আবেদন শুধুমাত্র হিন্দীতে করার নির্দেশ দেয়া হয়। বাঙালির মানভূমে তখন থেকেই শুরু হল এক রকম ‘হিন্দি-সাম্রাজ্যবাদ’।একের পরে এক বাংলা স্কুল পরিণত হল হিন্দি স্কুলে। পোস্ট অফিস-সহ সমস্ত সরকারি দফতরে হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হল।ফরমান
আসে, আদালতের সওয়াল-জবাব, চিঠিপত্র, জমির দলিল সব হবে হিন্দিতে। ঠিক যে কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপরে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হিন্দির আগ্রাসন মানভূমে যেন ঠিক ততটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল ১৯৪৮ থেকে।এর বিরুদ্ধেই মানভূমের ভাষা আন্দোলন।যেসব দাবিকে ঘিরে মানভূম ভাষা-আন্দোলন দানা বাঁধে সেগুলো হলো, বাংলা ভাষায় কথা বলা, বাংলা
ভাষায় লেখা, স্কুল-কলেজে হিন্দি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় পড়াশুনার ব্যবস্থা করা।গর্জে
ওঠে লক্ষ লক্ষ বাঙালি।শিক্ষা ও প্রশাসনিক স্তরে তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে স্বীকৃতির জন্য শুরু হয় আন্দোলন।
৩০শে এপ্রিল, ১৯৪৮ বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে অতুলচন্দ্র ঘোষের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের মানভূম জেলা কমিটির অধিবেশনে মানভূমের পশ্চিমবঙ্গভুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও মতভেদের কারণে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি।পুরুলিয়ায় ৩০শে মে’র সভায় বিষয়টি আবারও উত্থাপিত হলে তা ভোটে দেয়া হয়, কিন্তু প্রস্তাবটি ৪৩-৫৫ ভোটে হেরে যায়।বিহার রাজ্য সরকার মানভূমে বাংলার ব্যবহার সীমিত করার জন্য কঠোর হতে শুরু করলে ১৪ই জুন, ১৯৪৮ বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনের জন্য অতুলচন্দ্র ঘোষ,লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ,বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তসহ ৩৭ জন নেতা কংগ্রেসের জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করে লোক সেবক সংঘ গঠন করেন।এই সংঘ বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে।এই আন্দোলনের মধ্যে সভা-সমাবেশ, মিছিল ছাড়াও ছিল ঘরে ঘরে অরন্ধন,বিহার
রাজ্য সরকার মানভূমে চাল আমদানী বন্ধ করলে বাঁকুড়া থেকে ট্রাকে করে চাল আনা তথা খাদ্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন, এবং সরকার কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রিতে বাধা দিলে প্রকাশ্যে হাল-জোয়াল
বিক্রি তথা হাল-জোয়াল
আন্দোলন।বিহার রাজ্য সরকার বাংলাভাষীদের সভা-সমাবেশ ও মিছিল করা নিষিদ্ধ করলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে।
কিন্তু ১৯৪৬-এর বিহার নিরাপত্তা আইনের নামে অত্যাচার শুরু হল ভাষা আন্দোলনকারীদের উপরে।সত্যাগ্রহকে দমন করার জন্য হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিচিত্র দমনপীড়ণ। গ্রেফতার হয়েছেন সাত নেতা।পুরুলিয়া জুবিলি ময়দান, রাসমেলা ময়দানের সভাতেও লাঠি চালায় পুলিশ।সাঁতুড়ির জনসভায় পুলিশের লাঠির
আঘাতে মাথা ফাটে চিত্তভূষণ দাশগুপ্তের। মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করা হয় বহু নেতাকে।এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানান সর্ব স্তরের বাঙালি।শুরু হল ‘টুসু সত্যাগ্রহ’।মানভূমের লোকগান ‘টুসু’, সাধারণের স্বতোৎসারিত আবেগ মিশে থাকে।তাতেও
ফুটে উঠতে লাগল বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ।১৯৫২ সালে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হলেন ‘লোকসেবক সঙ্ঘে’র দুই জন প্রার্থী (ভজহরি
মাহাতো ও চৈতন মাঝি)।বিধানসভায় জিতে এলেন সাত জন।মানভূমে বাংলা
ভাষার আন্দোলন দৃষ্টি আকর্ষণ করল কলকাতা ও দিল্লির। লোকসেবক সংঘের একটি ছোট্ট পুস্তিকা ‘টুসু গানে মানভূম’ ঝড় তুলেছিল এই সময়। সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হল-
“শুন বিহারী ভাই, তোরা রাখতে লারবি ডাঙ্ দেখাই
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি, বাংলা ভাষায় দিলি ছাই
ভাইকে ভুলে করলি বড় বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই
বাঙালী-বিহারী সবই এক ভারতের আপন ভাই
বাঙালীকে মারলি তবু বিষ ছড়ালি — হিন্দী চাই
বাংলা ভাষার পদবীতে ভাই কোন ভেদের কথা নাই
এক ভারতের ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষার রাজ্য চাই”
(কবিঃ ভজহরি মাহাতো)
আর অন্য গানটি হলো অরুণ ঘোষের-
“বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে
ও ভাই মারবি তোরা কে তারে
এই ভাষাতেই কাজ চলেছে সাত পুরুষের আমলে
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে মুখ ফুটেছে মা বলে
এই ভাষাতেই পরচা-রেকর্ড,এই ভাষাতেই চেক কাটা
এই ভাষাতেই দলিল-নথি,সাতপুরুষের হক পাটা
দেশের মানুষ ছাড়িস যদি ভাষার চির অধিকার
দেশের শাসন অচল হবে,ঘটবে দেশে অনাচার”
(কবিঃ অরুণচন্দ্র ঘোষ)
টুসু গান আবহমানকালের যূথবদ্ধ সঙ্গীত। অথচ, দল বেঁধে গান গাইতে গেলেই তা অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হল।যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে টুসু গান গেয়ে গ্রেফতার হলেন অসংখ্য মানুষ।কারারুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের স্থানান্তরিত করা হল হাজারিবাগের মতো দূরের কারাগারে।পুলিশ
একজন টুসু গায়ক ১০ বছরের অন্ধ বালক বাবুলালকে গ্রেপ্তার করে ভাগলপুর জেলে পাঠায়।এখন যেখানে পুরুলিয়া জেলা জজের আদালত তার সামনে তখন একটি বড় মাঠ ছিল।সেই মাঠে সাধারণত মকর সংক্রান্তির টুসু গান গাওয়া হতো।১৯৫৪’র মকর সংক্রান্তিতে ঐ মাঠে যখন এসব গান গাওয়া শুরু হয় তখন শুরু হয় পুলিশী আক্রমণ।রাজ্য পুলিশ আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়।পুরো মানভূমে এই পুলিশী নির্যাতন আর গ্রেফতার চলতে থাকে টুসু সত্যাগ্রহের মাস জুড়ে।
মানভূম ভাষা আন্দোলনে নারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল অপ্রতিরোধ্য।জন নেত্রী লাবন্যপ্রভা দেবীকে পুলিশ ও রাজনৈতিক গুণ্ডারা চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে,পরে করে অকথ্য নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানী।শবরনেত্রী রেবতী
ভট্টাচার্যকে পিটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মৃত প্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় বিহারি পুলিশ।জন নেত্রী ভাবিনী মাহাতো দেবীকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়।বরাবাজার স্কুলে শ্রদ্ধেয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তকে নির্যাতন করা হয়।১৩ বছরের কিশোরদ্বয় সুধন্য মাহাতো ও হরিপদ মাহাতোকে টুসু সত্যাগ্রহী হওয়ার গ্রেপ্তার করা হয়।
এই সময় বিহারের জননিরাপত্তা আইনের ৯-এর (৫) ধারায়
১৭ জন টুসু সত্যাগ্রহীকে এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৩ (বেআইনী জনসমাগম), ২২৫ (সরকারি হেফাজত থেকে আসামী ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা) এবং ১৮৬ (সরকারি কাজে বাধা দান) ধারায়
লোকসেবক সংঘের কর্ণধার অতুলচন্দ্র ঘোষ, লোকসভা সদস্য
ভজহরি মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, অশোক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়।তিয়াত্তর বছর বয়সী, নিম্ন
রক্তচাপ ও ব্রঙ্কাইটিসের রোগী, স্বাধীনতা সংগ্রামী অতুলচন্দ্র ঘোষকে
পুরুলিয়া জেলে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীদের সাথে রাখা হয়,এরপর খোলা ট্রাকে চাপিয়ে ১৩৫ কিলোমিটার দূরের হাজারীবাগ জেলে স্থানান্তর করা হয়।লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাতোকে সাধারণ অপরাধীদের সাথে হাতে হাতকড়া দিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে আনা হয়।বিচারে তাঁর ১১ মাসের কারাদণ্ড হয়।লাবণ্যপ্রভা ঘোষকে ১ মাসের কারাদণ্ড ও ১০০ টাকা জরিমানা, প্রাদেশিক পরিষদ
সদস্য সমরেন্দ্র ওঝাকে ১ বছরের কারাদণ্ড ও ১,০০০ টাকা জরিমানা, অরুণচন্দ্র ঘোষসহ
পাঁচজনকে ১৪ মাসের কারাদণ্ড, অশোক চৌধুরী, রামচন্দ্র অধিকারী ও শ্রীশচন্দ্র ব্যানার্জীকে ১ বছর করে কারাদণ্ড এবং আরও ২৩ জন আন্দোলনকারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।বাবুলাল মাহাতো নামের পনের বছরের এক জন্মান্ধ কিশোরকে ৩ মাসের কারাদণ্ড ও ২০০ টাকা জরিমানা, এবং নয় বছরের বালক সুধন্বা মাহাতোকে ৯ মাসের কারাদণ্ড ও ১,০০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
এরই মধ্যে
শুরু হয় সীমা কমিশনের কাজ। সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের তৎকালীন দুই মুখ্যমন্ত্রীর (বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ) তরফে বঙ্গ-বিহার
যুক্ত প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব আসে।এ বার কেবল মানভূম নয়, প্রতিবাদ করেন কলকাতার বাঙালি বিদ্বজ্জনেরাও।ইতিমধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করে ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ নিষিদ্ধ ঘোষণা
করা হয়েছে।সাবেক
মানভূমের নানা স্থানে চলেছে বিহার পুলিশের ‘অত্যাচার’।ঝালদা ও জয়পুরে দোকান লুঠ হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেওয়া
হচ্ছে বাড়িঘর।
মানভূমের ভাগ্যের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায়
১৯৫৬ সালের এপ্রিলে লোক সেবক সংঘের আন্দোলনকারীরা কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সাড়ে তিনশ’ নারীসহ হাজার
দেড়েক আন্দোলনকারী দশটি বাহিনীতে ভাগ হয়ে পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে পদযাত্রা শুরু করেন।নারীদের বাহিনীটির নেতৃত্বে ছিলেন বাসন্তী রায়।পদযাত্রা বাঁকুড়া, বেলিয়াতোড়, সোনামুখী, পাত্রসায়র, খণ্ডঘোষ, বর্ধমান, রসুলপুর, মেমারী, পাণ্ডুয়া, মগরা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, গোঁদলপাড়া, শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, হাওড়া
পেরিয়ে ষোল দিন পর ৬ই মে কলকাতায় উপস্থিত হয়।২০ শে এপ্রিল থেকে ৬ ই মে, টানা ২১ দিন প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন সত্যাগ্রহীরা।কণ্ঠে
ছিল ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি আর ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বাংলা
ভাষা প্রাণের ভাষা রে’ ইত্যাদি গান।ধলভূমকে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবীতে গড়া মুক্তি পরিষদের ১৭৫ জন আন্দোলনকারী বঙ্কিমচন্দ্র চক্রবর্তী ও কিশোরীমোহন উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ধলভূম থেকে পদযাত্রা শুরু করে ৫ই মে কলকাতা পৌঁছে হাজরা পার্কে সভা করেন।নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সভাপতিত্বে ঐ সভায় সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সাতকড়ি রায় বক্তব্য রাখেন।৬ই মে অতুলচন্দ্র ঘোষের সভাপতিত্বে মানভূমের আন্দোলনকারীরা কলকাতার ময়দানে জনসভা করেন।কলকাতাবাসীদের পক্ষ থেকে হেমন্তকুমার, জ্যোতি বসু, মোহিত মৈত্র, সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট নাগরিকগণসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ উপস্থিত হয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।৭ই মে আন্দোলনকারীরা অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ডালহৌসীতে (বি-বা-দী বাগ) সমাবেশ করেন।সমাবেশ যেন না হতে পারে এজন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার আগে থেকে ১৪৪ ধারা জারী করে রেখেছিল।ফলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে পুলিশ ৯৬৫ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করে কলকাতা প্রেসিডেন্সী জেল, আলীপুর সেন্ট্রাল জেল ও আলীপুর স্পেশাল জেলে পাঠায়।বারো দিন পর তাঁরা মুক্তি পান।একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানে প্রায় ৩,৩০০ আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয় যারা প্রধানত লোক সেবক সংঘ অথবা বাম দলগুলোর কর্মী ছিলেন।
পরের ঘটনাক্রম দ্রুততর। বাধ্য
হয়ে রদ করা হয় বাংলা-বিহার
সংযুক্তির প্রস্তাব।বঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন পাশ হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগষ্ট বাংলা-বিহার
সীমান্ত নির্দেশ বিল লোকসভায় ও ২৮শে আগষ্ট রাজ্যসভায় পাশ হয়।১লা সেপ্টেম্বর এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সই করেন।মানভূম ভাষা আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালে মানভূমকে তিন টুকরো করে বাংলা অধ্যুসিত ১৬ টি থানা অঞ্চলে জুড়ে দিল পশ্চিমবঙ্গের সাথে অবলম্বনে জন্ম নিল পুরুলিয়া জেলা।সীমা কমিশনের রিপোর্ট লোকসভা হয়ে ‘সিলেক্ট কমিটি’ ও আরও নানা স্তর পেরিয়ে ১ লা নভেম্বর, ১৯৫৬,২৪০৭ বর্গ মাইল এলাকার ১১,৬৯,০৯৭ জন মানুষকে নিয়ে জন্ম নেয় আজকের পুরুলিয়া।সম্পূর্ণ ধানবাদ মহকুমা বিহার
রাজ্যে রয়ে যায়।টুসু সাধিকাদের সেই ভাষা আন্দোলন আজ জনমানসে বিস্মৃতপ্রায় হলেও ইতিহাসের দলিলে তা চিরভাস্বর।মানভূমের এ ভাষা আন্দোলন কোনও স্বাধীন দেশ গড়ার আন্দোলন ছিল না, ছিল কেবল বাংলা ভাষাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার লড়াই। আজকের প্রশাসনিক পুরুলিয়া সেই লড়াইয়েরই ফসল।
মানভূমের ভাষার
লড়াইয়ে কাউকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়নি সত্য তবে প্রায় ৯ বছর ধরে চলা আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষকে নানা প্রকার অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনা-অত্যাচার সইতে হয়েছে।হাজার হাজার জনকে জেলজুলুম আর পুলিশী নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।মানভূমের ভাষার আন্দোলন মানভূমবাসীর জন্য গৌরবের বিষয় তো বটেই সারা পৃথিবীর বাংলাভাষাভাষী মানুষ এই গৌরবের অংশীদার।কিন্তু কালে কালে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মোটামুটি সাধারণের জানার বাইরে চলে গেছে।বাংলাদেশ তো দূরে থাক পুরুলিয়ার বাইরে খোদ পশ্চিমবঙ্গেও সরকারী বা বেসরকারীভাবে মানভূমের ভাষা আন্দোলন নিয়ে বার্ষিক কোন অনুষ্ঠান বা আলোচনা হয় না।পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে মানভূমের ভাষা আন্দোলন অন্তর্ভুক্ত হলেও সেটা গোটা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষায়তনগুলোর পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই পায়নি।অতুলচন্দ্র ঘোষ,লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, ভজহরি মাহাতো, ভাবিনী মাহাতোদের মতো শত শত ভাষাসৈনিক তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা পাননি।
বাংলা এক আশ্চর্য ভাষা! এই ভাষাভাষীদের নিজের মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য লড়তে হয়েছে অখণ্ড বাংলার পশ্চিম সীমান্তের মানভূম থেকে পূর্ব সীমান্তের বরাক উপত্যকা পর্যন্ত।জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে দফায় দফায়।অত্যাচার-নির্যাতন সইতে হয়েছে বছরের পর বছর ধরে।লড়তে হয়েছে উর্দু, হিন্দী আর অসমীয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে।জানি না পৃথিবীতে আর কোন ভাষার জন্য এমন বার বার, নানা জায়গায়, নানা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লড়তে হয়েছে কিনা।ঐতিহাসিক মানভূম ভাষা আন্দোলনের কথা প্রচার করতে হবে।বাঙালি ভাষার
জন্য প্রাণ দিতে পারে।বাংলা
ভাষা বড় প্রিয় আমাদের। বাংলা ভাষা বাঁচাতে ও বাঙালির অধিকার আদায় করতে মানভূম ভাষা আন্দোলনের কথা বারবার স্মরণ করতে হবে।
জয় বাংলা।
Post a Comment