Header Ads

জেলাশাসক ডগলাস হত্যার নায়ক বিপ্লবী প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্য


চিঠিটি মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে তিনি পাঠিয়েছিলেন তাঁর মা’কে। সেই চিঠির কিছু কিছু অংশ নিম্নরূপ - 

‘কিন্তু আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি। তাতে আনন্দ আমার মনের কানায় কানায় ভরে উঠেছে। ফাঁসির কাঠটা আমার কাছে ইংরেজের রসিকতা মনে হচ্ছে। আমার এই অন্তরের কথাটা তোমারই অন্তরের প্রতিধ্বনি। আমি চিরদিনই জানি যে, আমি বাঙালী (বা ভারতবাসী) আর তুমি বাংলা (বা ভারতবর্ষ) একই পদার্থ। যুগ যুগ ধরে তুমি যে অপমান, লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ্য করে এসেছ, মাটিতে মুখ থুবড়ে বোবা গরুর মতো মার খেয়েছ, তারই বিরুদ্ধে তোমার মনে যে বিদ্রোহের ধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে যাচ্ছিল, সেই পুঞ্জীভূত বিদ্রোহ-ই আমি। বিপ্লব জিনিসটা কিছু আমোদের নয়, কিন্তু মানব জাতিকে ধ্বংসের হাত হতে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে এটার প্রয়োজন হয়েছে। যাঁদের প্রতিটি রক্তবিন্দু দাসত্বের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়ে গেছে তাঁদের কথা ভাবি না। ...কিন্তু যাঁরা মধ্যপন্থী, আপস মীমাংসায় এখনো বিশ্বাসবান, তাঁদের জন্য দুঃখ হয়।'


রাজবন্দি কৃষ্ণলাল চট্টোপাধ্যায় ফাঁসির আগের দিন তাঁর সাথে দেখা করে তাঁর কানে কানে বলেছিলেন, ‘ভাই, কাউকে কিছু বলবার আছে কি?’

তিনি বলেছিলেন, ‘আমার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে যেন একটি করে শহিদ তৈরি হয়।’

ডাকনাম কচি। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলেন। ধীরস্থির, শান্ত, মেধাবী ছেলেটি ১৯৩০ সালে মেদিনীপুরের হিন্দু স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে, স্থানীয় কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তার পরেই জীবন পালটে গেল। অথচ তাঁর পরিবারে কেউ কখনও স্বদেশি করেননি। বাবা ছিলেন রেভিনিউ এজেন্ট। বড় ভাই ডাক্তার। মেজ ভাই সাউথ ইস্টার্ন রেলের কর্মী। কলেজে পড়ার সময় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার বা বিভি মেদিনীপুর শাখার নিষ্ঠাবান যোদ্ধা দীনেশ গুপ্তের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। তাঁর তেজ, প্রাণোচ্ছলতা এবং রবীন্দ্রপ্রীতি মুগ্ধ করল দীনেশকে। তখন যুবকের বয়স সবে সতেরো।

দীনেশ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'তুমি জানো, ধরা পড়লে ফাঁসি, দ্বীপান্তর, অকথ্য অত্যাচার, ভাগ্যে যা খুশি জুটতে পারে। হাসিমুখে সইতে পারবে? ‘মন্ত্রগুপ্তি' রক্ষা করতে পারবে?’

উত্তরে যুবক তাঁকে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই। পারব।’

জেলাশাসক ডগলাস হত্যার পর তিনি ধরা পড়ে যান।তাঁর পকেট থেকে পাওয়া গিয়েছিল দু’টুকরো কাগজ। যার একটিতে লেখাছিল,

‘A fitting reply to premeditated and prearranged barbarous & cowardly attempt on the patriotic sons of Bengal— Bengal revolutionaries.’

আর অন্যটিতে লেখাছিল,

‘হিজলী হত্যার ক্ষীণ প্রতিবাদে— ইহাদের মরণেতে ব্রিটেন জানুক। আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক— বন্দেমাতরম।’

জেলে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। লাঠির আঘাত, নখে পিন ফোটানো, চেন দিয়ে প্রহার, বরফের চাঁইয়ের উপর চেপে শুইয়ে রাখা, লঙ্কার ধোঁয়া মুখে দেওয়া সবকিছুই সহ্য করেছিলেন মুখ বুজে। সারা দেহ রক্তাক্ত হয়েছিল কিন্তু দীনেশদাকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন তিনি। ব্রিটিশরা তাঁর কাছ থেকে কোন কথা বের করতে পারেনি।

১২ জানুয়ারি ১৯৩৩। জেলের ঘড়িতে সময় তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। ঘড়ির ঢং ঢং শব্দে জেগে উঠল ভোর। সেদিন ছিল কনকনে ঠান্ডা। চারিদিকে কুয়াশা। কিন্তু অত শীতেও তত ক্ষণে প্রদ্যোতের স্নান সারা। গীতাপাঠও করে নিয়েছেন। ঠিক ছ’টা বাজতে তিন মিনিট আগে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ফাঁসির মঞ্চে।

জেলের বিভিন্ন সেল থেকে গর্জন উঠল, ‘প্রদ্যোৎ কুমার কি জয়।’

তিনি ফাঁসির মঞ্চের ওপরে দাঁড়ালেন।

নিহত ডগলাসের পরবর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্জ জিজ্ঞেস করলেন, ‘Are you ready?’

শান্ত ভাবে প্রদ্যোৎ বললেন, ‘One minute please Mr. Burge, I have something to say.’

বার্জ অনুমতি দিলেন।

এ বারে প্রদ্যোৎ হাসতে হাসতে বললেন,
‘We are determined, Mr. Burge, not to allow any European to remain at Midnapore. Yours is the next turn. Get yourself ready.’ (এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। মাস সাতেক বাদেই বার্জকে হত্যা করেন মেদিনীপুরের বীর সন্তান অনাথবন্ধু পাঁজা এবং মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত)

একটু থেমে আবার বললেন,
‘I am not afraid of death. Each drop of my blood will give birth to hundreds of Prodyots in all houses of Bengal. Do your work please.’

তারপরে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা পড়ল। ফাঁসির দড়ি পরানো হল। তিনি শেষ বারের মতো উচ্চারণ করলেন, ‘বন্দে মাতরম’।

তাঁর নশ্বর দেহটা মঞ্চের নীচে অদৃশ্য হল। ফাঁসির দড়িটা কয়েক মুহূর্ত কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। দুই দাদা, প্রভাতভূষণ ও শক্তিপদ দেখেছিলেন সেই মৃত্যুদৃশ্য।

তিনি বাংলার গর্ব প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্য। আজ এই মানুষটির জন্মদিন। প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্য আমার সবসময়ের আদর্শের মানুষ। কি এমন ভালবাসা যার জন্যে জীবন দেওয়া যায় এই প্রশ্নের উত্তর প্রদ্যোতকুমার ভট্টাচার্য নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন যে। 


No comments