Header Ads

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও তরুণ সমাজ


যাঁদের বয়স হয়েছে তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ ব্যক্তিরাই কিছু অভিযোগ প্রায়শই করে থাকেন। তাঁদের অভিযোগগুলি তাঁদের অনুজ সন্তানসম তরুণদের প্রতি আর সেই অভিযোগগুলি হল ‘দেশের তরুণ সমাজ গোল্লায় গেছে। এদের মধ্যে ভালো কিছু কি আর আছে? এরা ভবিষ্যতে যে কি করবে তার ঠিক নেই।’ অর্থাৎ তাঁরা তরুণ সমাজের প্রতি ভরসা রাখতে  একেবারেই নারাজ বরং তাদের খুঁত ধরতেই সদা ব্যস্ত। আচ্ছা, তাঁরাও তো কোনো না কোনো দিন তরুণ ছিলেন, তার বেলা? এই প্রশ্নের উত্তরটি তাঁদের মুখে লেগে রয়েছে আর তা হল- ‘আমাদের সময় কি ভালো, কি ভালোটাই না ছিল। আমরা মোটেও এরকম ছিলাম না। আমরা..’ অর্থাৎ তাঁরা এমনভাবে কথাটা বলেন যেন ওনারা সবাই সত্যযুগের ভগবান শ্রী রাম ছিলেন কিংবা  মহাভারতের যুধিষ্ঠির। যাই হোক, তাঁদের এই অভিযোগগুলি নতুন নয় এটা বরাবরই ছিল। আমরা ফিরে যাব আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে। এক বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী, যিনি কিনা স্বদেশপ্রেমী আবার দেশের তরুণদের উপরও একরাশ ভরসা রাখেন। তরুণদের কাজ দেবার জন্যে এবং দেশকে স্বাবলম্বীন করতে একাধিক রাসায়নিক কল-কারাখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বলা যায় দেশের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানের শিক্ষক তাই ছাত্রদেরও অতি প্রিয় ‘স্যার’। তিনি ছাত্রদের কাছে শুধু শিক্ষক বা বলাবাহুল্য গুরুদেব নন, তিনি তাদের এক অতি প্রিয় বন্ধুও বটে এবং ভালো কাজ করার উৎসাহদাতা। তা একবার তাঁর কাছে এক প্রবীণ ভদ্রলোক এলেন যিনি ওই সাধারণ বৃদ্ধ সমাজের  মতোন তরুণ সমাজের প্রতি বড়োই বীতশ্রদ্ধ। তরুণদের প্রতি তাঁর একেবারেই ভরসা নেই।


তা সেই ভদ্রলোক অভিযোগ করলেন ওই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর কাছে, ‘আপনি যে দেশ-দেশ করে এত চেঁচামেচি করছেন এবং তরুণদের উপর এত যে আশা করছেন তা তরুণরা কি আপনার কথায় কান দিচ্ছে! তারা তো বলা যায় অধঃপতনের শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। 

প্রবীণ বিজ্ঞানী মহাশয় কথাটি শুনে মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, “তুমি যা দেখছ, তা হল নদীর বাঁক পথ।”

বৃদ্ধ লোকটি তো  অবাক। এ আবার কি কথা বলেন এই বিজ্ঞানী মহাশয়। অতএব তিনি কৌতূহল নিবারণের ন্যায় জিজ্ঞেস করলেন, “নদীর বাঁক পথ?” 

প্রবীণ বিজ্ঞানী কৌতূহল আঁচ করে জিজ্ঞেস করলেন, “বলতে পারো রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম কত সালে?”

- আজ্ঞে ১৭৭২ সালে। (যাক তাঁর জানা ছিল অন্তত)

এবার বিজ্ঞানী মহাশয় বললেন, “সে পলাশী যুদ্ধের কয়টা বছর পরে? পলাশীর যুদ্ধের পর মনে হয়েছিল দেশটা একেবারে শেষ হয়ে গেল। অথচ মাত্র কয়েকটা বছর পরেই গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে এল এক নতুন দিনের সূর্য। যিনি নবজাগরণের গান গেয়ে দেশকে চাঙা করে দিয়েছিলেন। নদী যেখানে বাঁক নেয় সেই জায়গাটাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় নদী বুঝি ওখানেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুটা এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবে যে নদী তার নিজের গতিতেই এগিয়ে চলেছে।”

এই উদাহরণের পাশাপাশি প্রবীণ বিজ্ঞানী বললেন, “আমি ওই তরুণদের উপর ষোল আনা আশা রাখি হে।”

হ্যাঁ, সত্যিই ওই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী তরুণদের উপর ষোল আনা আশা করতেন, বিশ্বাস রাখতেন। তখনকার সেই পরাধীনতার যুগে অনেকেই এমনকি নামজাদা নরমপন্থী নেতারাও তরুণ বিপ্লবীদের এবং তাঁদের আত্মত্যাগকে মেনে নিতে পারেননি। অথচ এই প্রবীণ বিজ্ঞানী মনে করতেন স্বাধীনতা আনতে বহু কষ্টের ও আত্মত্যাগের দরকার হয়। তা সে চরমপন্থা ও নরমপন্থা যে পথই হোক না কেন। দেশের তরুণ যাঁরা হাসিমুখে দেশ স্বাধীন করার জন্য ফাঁসির দড়ি বরণ করেছিলেন তাঁদের নিয়ে ওই বিজ্ঞানী সর্বদাই গর্ব অনুভব করতেন। দেশের যুবসমাজকে বলতেন, ‘চাকরি নয়, ব্যবসা কর।’ তিনি ডিগ্রিধারী যন্ত্রমানব নয় বরং আসল মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন। তাঁর নাম? ও হ্যাঁ, তাঁর নামটাই তো বলা হয়নি।তিনি আমাদের সকলের নমস্য, সকলের প্রণম্য আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।প্রতি বছর ২রা আগস্ট তাঁর জন্মদিবস পালিত হয়। সমাজের সবাই তাঁকে শত কোটি প্রণাম জানায় ও স্মরণ করে ঠিকই কিন্তু তাঁর আদর্শকে মেনে চলাটাই হবে তাঁর প্রতি আমাদের এক পরম শ্রদ্ধার্ঘ্য। উক্ত উদাহরণের মতো আরেকটা উদাহরণও দেওয়া হবে যাতেও বোঝা যাবে তিনি তরুণ সমাজের প্রতি কতটা আশা ভরসা করতেন।

তা, একদিন সকালে আচার্যদেব নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছিলেন। ওই সময় এক পরিচিত ভদ্রলোক দেখা করতে আসেন তাঁর সাথে। নিমের দাঁতনে দাঁত মাজা বড়োই ভালো ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। কিন্তু আজকাল যুবকরা আর কজন নিমের দাঁতনে দাঁত মাজেন? সেই অভিযোগ তিনি জানালেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কাছে। তিনি বললেন, “আপনি নিমের দাঁতনে দাঁত মাজছেন আর এদিকে তরুণরা পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজছেন। সেই পেস্ট আবার আপনার রাসায়নিক কারখানায় তৈরি হচ্ছে। তরুণদের এই বিলাসিতা কি আপনি মঙ্গল বলে মনে করেন?”  

এবারেও বিজ্ঞানী তরুণদের পক্ষেই দাঁড়ালেন। বললেন, “ওরা তরুণ। এটা ওদের ভোগ করার বয়স। ওরা কিছু ভোগ করতে চায়। তাই তো বাইরের বাজে জিনিসের বদলে খাঁটি জিনিস ওদের হাতে তুলে দিই। ওরা বড়ো হলে, মাথায় চাপ পড়লে ঠিক আমার আপনার মতোই হয়ে উঠবে।”

এই দুটি ছিল আচার্যদেবের তরুণদের প্রতি ষোল আনা ভরসা করার কাহিনী। বলাই যায়, তিনি তরুণদের উপর ষোল আনা ভরসা করতেন বলেই একগুচ্ছ বিজ্ঞান রত্ন আমাদের সমাজকে, আমাদের দেশকে উপহার দিয়ে গেছেন। এই বিজ্ঞান রত্নরাই দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করে গেছেন। তাই, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলতে পেরেছিলেন, “আমার অনেক রত্ন- রসিকলাল দত্ত, মেঘনাথ সাহা,‌ জ্ঞান ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ, নীলরতন, সত্যেন্দ্রনাথ কত, কত রত্ন!”

আর যাঁরা  তরুণদের উপর আশা ও ভরসা কোনোটাই রাখতে পারছেন না, যাঁদের মনে হচ্ছে যে দেশের তরুণরা গোল্লায় চলে গেছে, তাঁরা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন। 




No comments