Header Ads

স্বাধীনতার এক অজানা অধ্যায়

৭ই ডিসেম্বর ১৯৪১, রাত নটার সময় এক অজ্ঞাত রেডিও স্টেশন থেকে ভেসে এলো এ কার কন্ঠস্বর? ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা স্বরে চমকে উঠলো গোটা দেশ .......!

"আজাদ হিন্দ রেডিও বার্লিন, আমি সুভাষ বলছি।অক্ষশক্তির আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য যদি বৃটেন আমেরিকার দ্বারস্থ হতে হতে লজ্জা না পায় তাহলে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অপর কোন জাতির সাহায্য প্রার্থী হওয়া আমার পক্ষে অন্যায় নয় অপরাধও হতে পারেনা!"



১৭ই জানুয়ারী অন্তর্ধানের পর এই প্রথম বার তিনি এলেন জনসমক্ষে।ততদিনে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জার্মানিতে বসে যুদ্ধবন্দী ভারতীয় সেনাদের নিয়ে তৈরী করলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ, গঠন করলেন আজাদ হিন্দ সরকার।পূর্ণ কূটনৈতিক মর্যাদা দিলেন হিটলার এবং সেখানেই প্রথম পরিচিত হলেন #নেতাজী রূপে


এই ইতিহাস তো অনেকেই জানেন কিন্ত জানেন কি এরও ত্রিশ বছর আগে আরও এক বঙ্গসন্তান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জার্মানির সাহায্য নিয়ে দেশ থেকে বৃটিশ শাসনের অবসান করতে চেয়েছিলেন?

‘'India has to rise with her own strength” এটাই ছিল তাঁর মূলমন্ত্র


১৯০৫ সাল, স্বদেশী আন্দোলনের রাশ টানতে বড়লাট কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিলেন।গর্জে উঠলো বাংলার যুবসমাজঋষি অরবিন্দের অনুপ্রেরণায় গঠিত হলো গুপ্ত সংগঠন যুগান্তর, কিছুদিনের মধ্যেই সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো এর শাখা সংগঠন।লাখো সদস্যের এই সংগঠনে সমন্বয়ের দায়িত্বে রইলেন কুড়ি বছরের এক যুবক, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যয়।আওয়াজ উঠলো "আমরা মরবো জগত জাগবে"

স্বাধীনতা আন্দোলনে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়ের.......... অগ্নিযুগ! ‌

বিভিন্ন জায়গায় এরা তৈরী করতে লাগলেন বোমা তৈরির কারখনা, সাহসী যুবকদের উৎসাহিত করে শুরু করলেন ইংরেজ রাজপুরুষদের ওপর আক্রমণ।এরই মধ্যে আলিপুর বোমার মামলায় অরবিন্দ সহ গ্রেফতার হলেন যতীন।এগারো মাস জেলে থেকে তিনি উপলব্ধি করলেন এইভাবে দুচারজন ইংরেজ মেরে স্বাধীনতা আনা যাবেনা, দরকার ১৮৫৭ সালের মতন আরো একটা দেশজুড়ে সর্বাত্মক বিপ্লব।১৯১২ সালে কলকাতা এসেছিলেন জার্মানির যুবরাজ দ্বিতীয় উইলহেম।শত্রুর শত্রু বন্ধু এই নীতি নিয়ে যতীন একদিন দেখা করলেন তার সাথে, খুলে বললেন তার উদ্দেশ্য।বৃটিশ শাসন উৎখাতের জন্য চাইলেন অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ।ইউরোপ ভূখণ্ডে সেসময় শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যতীন দেখলেন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের এটাই প্রকৃত সময়।নির্বাসিত ভারতীয় বিপ্লবী যারা সেসময় জার্মানী ও আমেরিকা ভূখণ্ডে কাজ করছিলেন, তাদের সবাই কে নিয়ে এলেন এক ছাতার তলায়।সরোজিনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রনাথ সেসময় জার্মানিতে গড়ে তুলেছিলেন বার্লিন কমিটি, যতীনের ডাকে সাড়া দিয়ে তারাও জার্মান প্রশাসন কে রাজী করালো অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্যের জন্য।আমেরিকা থেকে লালা হরদয়াল ও তার গদর পার্টিও বাড়িয়ে দিলো সহযোগিতার হাত।যতীন নিজে ফোর্ট উইলিয়ামের দেশীয় সেনাদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন

এর মধ্যে যুগান্তর পার্টির সদস্যরা রডা কোম্পানীর আমদানী করা প্রচুর পিস্তল কায়দা করে সরিয়ে ফেললো আর গার্ডেনরীচে দিনের বেলাতেই লুট করে নিল বার্ড কোম্পানীর টাকা।এই ঘটনায় যতীনের নাম সামনে আসায় উনি পালিয়ে যান উড়িষ্যার ময়ুরভঞ্জে

বার্লিন থেকে এসময় খবর আসে SS Maverick নামে এক জার্মান জাহাজ মেক্সিকোর বন্দর থেকে প্রায় ত্রিশ হাজার রাইফেল ও গোলাবারুদ নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে।জাভা হয়ে সেটি উড়িষ্যার উপকূলে আসবে।যতীন তার সহযোগী MN Roy কে এটির তদারকির ভার দেন এবং সেই উদ্দেশ্যে তিনি ইন্দোনেশিয়া যাত্রা করেন।সেখানে সবকিছু ব্যাবস্থা করে 1915 সালের জুন মাসে মাদ্রাজে ফিরে আসেন ও যুগান্তর সদস্য যাদুগোপাল মুখার্জীকে টেলিগ্রাম পাঠান

“…arrived here, starting tonight for Balasore, expect to meet someone there.”

দুর্ভাগ্যক্রমে এই টেলিগ্রামটি ইংরেজ গোয়েন্দাদের নজরে আসে ও তারা এটি পাঠিয়ে দেয় পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্টের কাছে

দুর্ভাগ্য কখনো একা আসেনা, গদর পার্টির এক বেইমান এই পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয় মার্কিন গোয়েন্দাদের।আবার যে জার্মান অফিসারের ওপর অস্ত্র বোঝাই করার তদারকির ভার ছিল সেও টাকা খেয়ে এই খবর বৃটিশ গোয়েন্দাদের জানিয়ে দেয়।SS Maverick কোনদিনই আর ভারতীয় উপকূলে পৌঁছালো না!


কলকাতার বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়ে যায় ব্যাপক তল্লাশী, পুলিশের হাতে আসে ময়ুরভঞ্জের কাপ্তিপদা বলে এক জায়গার নাম


বুড়িবালাম নদীর তীরে জীবনের শেষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে বিশ্বাসী, অমিত শক্তিধর এই মানুষটি জীবনের অনেক অসম যুদ্ধে জিতেছিলেন।কৈশোরে সাঁতার কাটতে গিয়ে পা জড়িয়ে গিয়েছিলো জলের নিচের শ্যাওলায়...কোনমতে জলের নীচের শ্যাওলা ছিঁড়ে উঠে এসেছিলেন। প্রথম যৌবনে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার সময় জঙ্গলের মধ্যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সামনে পড়ে যান। নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বাঘকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে গলায় বসিয়ে দেন কুকরি।সেই লড়াইয়ে, বাঘের নখ এবং দাঁতের আঘাতে প্রাণ সংশয় হয় ওনার।দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে।দু দুবার বাঙ্গালী মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য একদল ইংরেজ যুবককে একা বেধড়ক মেরে ধরাশায়ী করেন,একবার ট্রেনে,আরেকবার কলকাতার রাস্তায়।

মাউজার পিস্তল হাতে নিয়ে, বৃটিশ রাইফেলের বিরুদ্ধে প্রায় এক ঘন্টা লড়াই চালাবার পরে অবশেষে পরাজিত হলেন যতীন্দ্রনাথ এবং তাঁর তিন সাথী।জনশ্রুতি,পরদিন বালাসোর হাসপাতালে যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়, তখন এক ইংরেজ অফিসার তাঁর মুখে জল দিতে আসেন।কিন্তু যতীন্দ্রনাথ সাহেবের বাড়িয়ে দেওয়া জল প্রত্যাখ্যান করেন।তাঁর যুক্তি ছিলো, যে ইংরেজ তাঁর দেশের লোকের উপর অত্যাচার করে, সেই ইংরেজের হাতে তিনি জলগ্রহন করবেন না।এক বুক তৃষ্ণা নিয়েই তিনি পাড়ি দেন অমৃতলোকের পথে।জীবিত বাঘা যতীন বাঘের মতনই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন,দিনটা ছিল ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৫।

পুলিশ কমিশনার টেগার্ট তাঁর আত্মজীবনী তে লেখেন-যতীন্দ্রনাথ যদি ইংল্যান্ডে জন্মাতেন, তবে ট্রাফালগার স্কোয়ারে লর্ড নেলসনের মূর্তির পাশে তাঁর মূর্তি রাখা হতো।” ‌

উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও তার এই পরিকল্পনা বৃটিশ শাসনের ভিত্তিমূল নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।এমনকি টেগার্ট অব্দি তাঁর মৃতদেহের সামনে টুপি খুলে বলেছিলেন,

‘Bagha Jatin, the Bengali revolutionary, is one of the most selfless political workers in India. His driving power (…) immense: if an army could be raised or arms could reach an Indian port, the British would lose the war."


আজ তাঁর মহাপ্রয়াণ দিবসে রইল শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন।




2 comments: