বুড়িবালামের তীরের যুদ্ধের প্রথম শহীদ বিপ্লবী চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী
বালেশ্বেরের জঙ্গলে
বাঘাযতীনের সঙ্গী ছিলেন মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী,নীরেন দাশগুপ্ত, জ্যোতিষ পাল।সকলের
কাছেই বাঘাযতীনের একটাই পরিচয় সকলেই কাছেই তিনি ছিলেন দাদা।সেই দাদা যার এক ডাকে
সবকিছু করতে তৈরী মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয়
রায়চৌধুরী,নীরেন দাশগুপ্ত, জ্যোতিষ পাল।
-দাদা দেশের কাজ করে কি
ভগবানকে পাওয়া যাবে?
-তা যদি না হত আমাকে কেউ এই পথে দেখতিস না।
চিত্তপ্রিয়ের সাথে সেদিন
বাঘাযতীনের প্রথম দেখা।তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস। দাদার উত্তরে মুগ্ধ
চিত্তপ্রিয় যোগ দেন দাদার দলে। খুব প্রিয় ছিলেন দাদার। ছিলেন বালেশ্বরের জঙ্গলের সঙ্গী এবং বুড়িবালামের তীরের
লড়াইয়ের প্রথম শহীদ। ১৯১৫ সালের ৯ই
সেপ্টেম্বর বুড়িবালামের তীরে যুদ্ধে সংগ্রামরত অবস্থায় বিপ্লবী নেতা বাঘাযতীনের
কোলে মাথা রেখে প্রাণত্যাগ করেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী।
১৮৯৪ সালে মাদারীপুরের
খালিয়া গ্রামে চিত্তপ্রিয় জন্মগ্রহণ করেন।পিতা প্রতাপশালী জমিদার পঞ্চানন
রায়চৌধুরী।চিত্তপ্রিয় পরিবারের সেজ ছেলে। কিন্তু ছোট থেকেই একটাই ধ্যান জ্ঞান-দেশের জন্যে কিছু করতে
হবে।হাইস্কুলের সেকেন্ড ক্লাসে পড়ার সময় আলাপ হয় বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাসের সাথে।দীক্ষিত
হন বিপ্লবী চেতনায়।
সিদ্ধ এক তান্ত্রিকের বংশে
জন্মেছিলেন তিনি। ধর্ম কর্মের উপর
ছোটবেলা থেকেই আসক্তি। গভীর রাতে তাঁকে ধ্যান করতে দেখা যেত মাঠে, নদীর ধারে, কালীবাড়িতে, শ্মশানবাড়িতে।ভগবানকে দেখার আশায় ছিলেন সবসময়। দেশের কাজ করলে কি ভগবানকে
পাওয়া যায়? এটা বাঘাযতীনের সাথে প্রথম
সাক্ষাতেই জিজ্ঞেস করেছিলেন।
১৯১৩ সালে রাজনৈতিক ডাকাতির
অভিযোগে পূর্ণ দাসের সঙ্গে মাদারীপুর ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হন।পরে
প্রমাণাভাবে মুক্তি পান।জেলের মধ্যে একবার সোডার বোতল ফেটে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল তাঁর
সমগ্র শরীরে। সেগুলো যখন ডাক্তার ছুরি চালিয়ে বের করে দিচ্ছেন তখনও হাসছিলেন তিনি। দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কোথায়
কাঁচ ফুটেছে।
জেল থেকে বেরিয়ে গার্ডেনরীচ
মোটর ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করে বার্জ কোম্পানির ১৮,০০০ টাকা লুঠ করেন তিনি।গোয়েন্দা নীরোদ হালদারকে হত্যা করেন
ও গোয়েন্দা সুরেশ মুখার্জীকে যারা হত্যা করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি।
(সুরেশ মুখার্জী হত্যা এক রোমহর্ষক কাহিনী,
অন্যকোনোদিন বিশদে জানানো হবে)
হাতে তাঁর কররেখা বলে কিছু
ছিল না।ভগবানও বোধহয় তাঁর নিয়তির
ভার তাঁর নিজের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
বুড়িবালামের যুদ্ধে
বাঘাযতীন, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী মাউজার পিস্তল (রডা কোম্পানি থেকে যে
অস্ত্র ডাকাতি করা হয়েছিল সেই অস্ত্র ব্যবহার করেছিল বিপ্লবীরা-যে ডাকাতি দি
গ্রেটেস্ট ডেলাইট রোবারি বলে বিখ্যাত) তাক করে রইলেন।জ্যোতিষ আর নীরেন
পিস্তলগুলোতে গুলি ভরে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন।ব্রিটিশদের ধারণা ছিল না যে বিপ্লবীরা
মাউজার পিস্তল ব্যবহার করছেন।এই মাউজার পিস্তলে বাট লাগিয়ে দিলে তা রাইফেলের মতই
শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
টিলা থেকে তখন সৈন্যবাহিনীর
দূরত্ব আড়াইশো গজের কাছাকাছি।
- ফায়ার!
নির্দেশ দিলেন বাঘাযতীন।
গর্জে উঠল বাঘাযতীন, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীর মাউজার পিস্তল। রাদারফোর্ডের
সৈন্যবাহিনীর কয়েকজন লুটিয়ে পড়লেন ধানক্ষেতে।তারা আর উঠল না।রাদারফোর্ড উপুড় হয়ে
বসে পড়লেন।গুলি চালাল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী।চারিদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে
আসছে বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে।
এদিকে সূর্য তখন অস্ত
যাচ্ছে।চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে।হঠাৎ ডান কনুইতে গুলি বিঁধল। ফিনকি
দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।তাই দেখে বাঁ হাতেই অস্ত্র ধরে গুলি চালাতে লাগলেন তিনি।
রাদারফোর্ডের একটা গুলি
চিত্তর মাথা ঘেঁষে চলে গেল।চিত্ত আবার গুলি চালাতে গেল। হঠাৎ ১৫ থেকে ২০ টা বুলেট
ঝাঁজরা করে দিল চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীকে। "দাদা" বলে লুটিয়ে পড়লেন চিত্ত।
বাঘাযতীনের তলপেট তখন গুলির
আঘাতে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।সেই অবস্থাতেই চিত্তকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর দাদা।দাদার কোলেই
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল চিত্ত।
তথ্য-বাঘাযতীন(লেখক-পৃথীন্দ্রনাথ
মুখোপাধ্যায়)
Post a Comment