Header Ads

বিস্মৃতির পথে ১৯১৫ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বরের সেই ঐতিহাসিক দিন

পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর চিন্তামণি সাহু বালেশ্বরে যাদের খবর নিতে পাঠিয়েছিল, তাদের মধ্যে রঙ্গ রাউত আর মুরলি মোহান্তি একদম পাকা খবর দিল বালেশ্বরের কাছাকাছি আছে বিপ্লবীরা। পুলিশ সুপারিটেনডেন্ট ছুটল জেলাশাসক কিলবির কাছে। 



কিলবি ইতিমধ্যেই সৈন্যসামন্ত জোগাড় করে ফেলেছে।কিলবি তখনই পুলিশ সুপারিটেনডেন্টকে আদেশ দিলেন বালেশ্বরের দিকে রওনা দিতে।নির্দেশ পেয়েই রওনা দিল কয়েকশো সশস্ত্র সৈন্য। 

ঘটনাস্থলে পৌঁছাতেই গ্রামবাসীরা ব্রিটিশদের দেখিয়ে দিল টিলার পথ। যে টিলার উপরে আত্মগোপন করেছে বিপ্লবীরা। চারিদিক ঘিরে ফেলল সশস্ত্র বাহিনী। টিলা থেকে তখন তারা ৪০০ গজ দূরে। ধীরে ধীরে তারা টিলার চারিদিকে এগিয়ে চলল। এদিকে রাদারফোর্ডের নেতৃত্বে আরও কয়েকশো সশস্ত্র সৈন্য তখন যোগ দিয়েছে সেখানে। কিলবি তখন টিলার বাঁদিকে বন্দুক তাক করে ধানক্ষেতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। রাদারফোর্ড খুব শীঘ্র টিলার ডানদিকের নেতৃত্ব দিতে চলে গেলেন। 

বাঘাযতীন, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী,নীরেন দাশগুপ্ত, জ্যোতিষ পাল বাংলার পাঁচ বীর সন্তান তখন টিলার উপরে। তারা দেখতে লাগলেন ব্রিটিশ সেনারা টিলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।  

বাঘাযতীন, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী মাউজার পিস্তল (রডা কোম্পানি থেকে যে অস্ত্র ডাকাতি করা হয়েছিল সেই অস্ত্র ব্যবহার করেছিল বিপ্লবীরা - যে ডাকাতি দি গ্রেটেস্ট ডেলাইট রোবারি বলে বিখ্যাত) তাক করে রইলেন। জ্যোতিষ আর নীরেন পিস্তলগুলোতে গুলি ভরে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন। ব্রিটিশদের ধারণা ছিল না যে বিপ্লবীরা মাউজার পিস্তল ব্যবহার করছেন। এই মাউজার পিস্তলে বাট লাগিয়ে দিলে তা রাইফেলের মতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 

টিলা থেকে তখন সৈন্যবাহিনীর দূরত্ব আড়াইশো গজের কাছাকাছি।

- ফায়ার!

নির্দেশ দিলেন বাঘাযতীন। গর্জে উঠল বাঘাযতীন, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীর মাউজার পিস্তল। রাদারফোর্ডের সৈন্যবাহিনীর কয়েকজন লুটিয়ে পড়লেন ধানক্ষেতে। তারা আর উঠল না। রাদারফোর্ড উপুড় হয়ে বসে পড়লেন। গুলি চালাল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী। চারিদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে। 

এদিকে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। হঠাৎ বাঘাযতীনের ডান কনুইতে গুলি বিঁধল।  ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তাই দেখে বাঁ হাতেই অস্ত্র ধরে গুলি চালাতে লাগলেন তিনি। 

রাদারফোর্ডের একটা গুলি চিত্তর মাথা ঘেঁষে চলে গেল। চিত্ত আবার গুলি চালাতে গেল। হঠাৎ ১৫ থেকে ২০ টা বুলেট ঝাঁজরা করে দিল চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীকে। "দাদা" বলে লুটিয়ে পড়লেন চিত্ত। 

বাঘাযতীনের তলপেট তখন গুলির আঘাতে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেই অবস্থাতেই চিত্তকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর দাদা। দাদার কোলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল চিত্ত। 

- দাদা গুলি যে শেষ হয়ে আসছে...

বলল জ্যোতিষ। 

- না রে ওই চামড়ার থলিটাই অনেক গুলি আছে। 

বলল বাঘাযতীন। 

জ্যোতিষ আর নীরেন অনেক চেষ্টা করল থলি খুঁজে বের করার। কিন্তু না সেই থলি আর পাওয়া গেল না। হঠাৎ একটা মারাত্মক বুলেট এসে গুড়িয়ে দিল বাঘাযতীনের বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো। 

গুলি লাগল জ্যোতিষ পালের বুকে। নীরেনের জামা রক্তে ভিজে যাচ্ছে।  

দাদার ওই অবস্থা দেখে মনোরঞ্জন পাশের ডোবা থেকে হাতে করে জল নিয়ে এসে ছিঁটিয়ে দিল দাদার মুখে। 

- চিত্ত তো চলেই গেল। আমারও দেরি নেই। তোরা থাকলি। মরবার আগে দেশবাসীকে শুধু বলে যাস আমরা ডাকাত নই। ওদের বলিস - আমরা মরতেই চেয়েছিলাম , দেশের লোক জেগে উঠবে বলে। দেশের মঙ্গল হবে বলে। 

মুখ থেকে তখন রক্ত উঠছে বাঘাযতীনের। লুটিয়ে পড়লেন তিনি। 

বিপ্লবীরা তখন ছন্নছাড়া। গুলিও শেষ। টিলা দখল করেছে ব্রিটিশরা। রাদারফোর্ডের আদেশানুসারে আর গুলি চালাল না সৈন্যবাহিনী। বাঘাযতীন, নীরেন, জ্যোতিষ ও মনোরঞ্জন ধরা দিল ব্রিটিশদের কাছে। জলপান করে তেষ্টা মেটালেন বিপ্লবীরা। 

-আমার সঙ্গে এই ছেলেরা নিরাপরাধ। যা কিছু ঘটেছে তাঁর জন্যে আমি দায়ী। একটু দেখবেন এদের উপর যেন অবিচার না হয়। 

কিলবিকে বললেন বাঘাযতীন।

তখন গ্রামবাসীরা ভিড় করেছে ঘটনাস্থলে। তারা বুঝলেন যাদের সাথে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করলেন একটু আগে তারা ডাকাত নয়। 

সকলকে নিয়ে আসা হল বালেশ্বর হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর নীরেন ও মনোরঞ্জন ছাড়া পেলেন। তাদের নিয়ে যাওয়া হল জেলখানায়।চিত্তকে পাঠিয়ে দেওয়া হল মর্গে। জ্যোতিষ পালকে রাখা হল হাসপাতালে। এদিকে বাঘাযতীনের অবস্থা তখন সঙ্কটজনক। ডান হাতের আঙ্গুল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। তলপেটে বুলেটের আঘাত। তাজা রক্ত বেরোচ্ছে। হচ্ছে রক্তবমি। 

তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল অপারেশন কক্ষে। 

-আমার সঙ্গে এই ছেলেরা নিরাপরাধ। যা কিছু ঘটেছে তাঁর জন্যে আমি দায়ী। একটু দেখবেন এদের উপর যেন অবিচার না হয়।

কিলবিকে আবার বাঘাযতীন বললেন এই কথা।

আবার রক্তবমি হল। হাসতে হাসতে বললেন -

- এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।

রাতেই অপারেশন হল। পরদিন পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট এলেন বাঘাযতীনের সাথে দেখা করতে। সাথে রাদারফোর্ড, বার্ড, ডেনহ্যাম। 

- গুড মর্নিং মিস্টার টেগার্ট। হাউ আর ইউ ?

- বলুন মুখার্জী আপনার জন্যে কিছু করতে পারি ?

- আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালোই হল। আমি চললাম। যারা রইল - তারা নির্দোষ। আমার প্ররোচনাতেই এ পথে তারা এসেছে। দেখো তাদের উপর যেন অন্যায় অত্যাচার না হয়। 

টেগার্ট বের হয়ে গেলেন। ততক্ষনে স্টিচ ছিঁড়ে গিয়েছে বাঘাযতীনের। রক্ত বেরোচ্ছে। হচ্ছে রক্তবমি। সমস্ত প্রচেষ্টাকে উপেক্ষা করে পরলোকগমন করলেন বাঘাযতীন। 

বিচারে ফাঁসি হয়েছিল মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন দাশগুপ্তর। দীপান্তর হয়েছিল জ্যোতিষ পালের। 

১৯১৫ সালের ২২ শে নভেম্বর বালেশ্বরের জেলে ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান নাম লেখালেন এই দুই বীর বাঙালি যুবক।  ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে বলেছিলেন - "ভারতে ইংরেজ শাসন বন্ধ হোক। ডাউন উইথ দি ব্রিটিশ রাজ্ ইন ইন্ডিয়া।"

জ্যোতিষ পালের উপর অমানুষিক অত্যাচার হয় সেলুলার জেলে। উন্মাদ হয়ে যান জ্যোতিষ। তাঁকে নিয়ে আসা হয় বহরমপুর জেলে। সেখানে একটু স্বাভাবিক হলে জেলের দেওয়ালে কাঠ কয়লা দিয়ে জ্যোতিষ লিখেছিলেন বুড়িবালামের যুদ্ধের কাহিনী। ১৯২৪ সালের ৪ ঠা ডিসেম্বর জেলে মৃত্যু হয় তাঁর (কারণ অজ্ঞাত)। অথচ তাঁর কিছুদিনের মধ্যেই জ্যোতিষের ছাড়া পাওয়ার কথা ছিল জেল থেকে। 

ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে এই ইতিহাস। মুছে দেওয়া হচ্ছে অনেক ইতিহাস। আর বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। না হলে কি বাঘাযতীন, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী,নীরেন দাশগুপ্ত, জ্যোতিষ পাল এদের কথা কেউ ভুলে যেতে পারে ?



তথ্য - বাঘাযতীন (লেখক -পৃথীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)

1 comment:

  1. In the very interesting presentation of "bismritir pathé 1915 sâler 9 september", a small error has appeared: instead of "biplabirâ chhatrabhanga" you have written "chhannachhâDâ (which has an unexpected slant of accusation).Prithwindra Mukherjee

    ReplyDelete