Header Ads

অগ্নিযুগের মেঘনাদ

সে অনেকদিন আগের কথা......

দেশ তখন পরাধীন।বাংলার একদল দামাল‌ ছেলে অনুধাবন করলো কংগ্রেস দলের কয়েকজন ইংরেজী বলা বাঙালি নেতার ভাষণ শুনে ভয় পেয়ে বৃটিশরা কোনদিনই স্বাধীনতা দেবে না।তার জন্য চাই লড়াই, হত্যা করতে হবে ইংরেজ রাজপুরুষদের।সতীশচন্দ্র বসু, ব্যারিস্টার পি মিত্র প্রমুখেরা ঠিক করলেন এমন একটি সংগঠন তৈরি করতে হবে যা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কাজকর্ম করলেও গোপনে অংশ নেবে বৈপ্লবিক কর্মসূচিতে। ‌

১৯০২ সালের দোল পূর্ণিমার দিনে বাংলার ১০ই চৈত্র (২৪শে মার্চ) কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় অনুশীলন সমিতি।

কিছুদিন পরে তাদের নজরে এলো বিদেশী।

গোরাদের থেকেও ভয়ঙ্কর এ দেশের মীরজাফরের দল।সাহেবদের একনজরে আসার জন্য এরা বিপ্লবী ও তাদের পরিবারের জীবন দুর্বিসহ করে তুলেছে।কারণে অকারণে থানায় ডেকে আটক মারধর হয়ে উঠলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।


এমনি একজন ছিল পুলিশ ইনসপেক্টর নৃপেন ঘোষ।তার অত্যাচারে বাঙালি বিপ্লবীরা সেদিন অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন।অনুশীলন সমিতির সদস্য নির্মলকান্ত রায়ের ওপর ভার পড়লো নৃপেনকে চিরকালের জন্য দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার।

১৯১৪ সালের ১৯ শে জানুয়ারি, সকাল এগারোটা।

চিৎপুর রোড আর শোভাবাজার স্ট্রীট ক্রসিং এ ট্রাম থেকে নামলো নৃপেন।খবর থাকায় পিস্তল নিয়ে আগেই সেখানে অপেক্ষা করছিলো নির্মল।নামার সাথে সাথেই তাকে লক্ষ্য করে ফায়ার করলেন।উত্তেজনায় হলেন লক্ষ্যভ্রষ্ট, অথচ গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল নৃপেন।মাথায় একটা ও শরীরে দুটো গুলি, রীতিমতো অবাক কান্ড। এলাকায় তখন পথচলতি মানুষের ভীড়, অনেকেই দেখেছে নির্মলকে ফায়ার করতে।ধর ধর করে তাড়া করলো পাহারারত পুলিশ সাথে হুজুগে মানুষ।সবার আগে ছুটছে অতি উৎসাহী অনন্ত তেলী।ধরতে পারলেই যে মোটা টাকার পুরস্কার! 

পুরষ্কার অবশ্য হাতেনাতে পেয়ে গেলো, কোথা থেকে আরো একটা গুলি এসে তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো।

নির্মলকান্ত ধরা পড়লেন পাঁচঘরা একটা রিভলভার সমেত।অনুশীলন সমিতির আরো এক বিপ্লবী প্রিয়নাথ ব্যানার্জী ছিলো আশেপাশে, ধরা পড়লেন তিনিও।

পুলিশের অসামান্য কর্মতৎপরতায় ধন্য ধন্য রব উঠলো চারিদিকে, উচ্ছ্বসিত সরকারি প্রশংসায় ভেসে গেল লালবাজার।Statesman পত্রিকা নৃপেনের মৃত্যু ও অপরাধী ধরা পড়ায় হাসি কান্না মিশিয়ে লিখলো ....."The unfortunate Inspector was an able and honest officer whose sole fault was his faithful discharge of his duty, and his reward is to be shot down in a crowded street where any man might suppose himself to be safe. Happily, his assassin has been caught."‌ 


যথাসময়ে বিচার শুরু হলো হাইকোর্টে।জাস্টিস স্টিফেনের এজলাসে মামলার শুনানী চলতে লাগলো 'Emperor vs Nirmal Kanta' কেসের।এদিকে ব্যালাস্টিক এক্সপার্ট নিশ্চিত ভাবে জানালেন নিহত নৃপেনের দেহে প্রাপ্ত তিনটি বুলেটের একটিও নির্মলকান্তের রিভলভার হতে বেরোয়নি।ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা আরো জানালেন অনন্ত তেলিও তার গুলিতে মারা যায়নি।সবাইয়ের সামনে খুন ও হাতে নাতে গ্রেপ্তার হলেও তার গুলিতে যে দুজনের কেউই মারা যায়নি সেটা একরকম নিশ্চিত করলেন তারা।আর প্রিয়নাথের কাছে তো কোনো আগ্নেয়াস্ত্রই ছিলনা। তাহলে হত্যাকারী কে!

এই রহস্যের মীমাংসা করতে পারেনি পুলিশ।১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে নয়জন জুরির মধ্যে সাতজনের মতের ভিত্তিতে আদালত নির্মলকান্তকে খালাস দিয়ে বাধ্য হয়।বেকসুর খালাস পেলেন প্রিয়নাথ ব্যানার্জিও।নির্মলের গুলিতেই যে দু দুটো খুন হয়েছে তা প্রমাণই করা গেলনা।জনতা তাকে খুনী মনে করে তাড়া করে ধরেছে সবই ঠিক, কিন্তু মেঘের আড়ালে মেঘনাদটি কে ছিলেন তা অজানাই রয়ে গেল।‌‌

স্বাধীনতার অনেক পরে জানা যায় সেদিন ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অনুশীলন সমিতির আরেক সদস্য খগেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী।নির্মলকে ব্যর্থ হতে দেখে তিনি গুলি চালান।অব্যর্থ লক্ষ্যে ফেলে দেন প্রথমে নৃপেন ও পরে অনন্ত তেলীকে, তারপর ভিড়ে মিশে যান।

পুলিশ রেকর্ডে নৃপেন ঘোষ ও অনন্ত তেলীর খুনী আজো অধরাই রয়ে গেছে! 

তথ্য সৌজন্য:'পুরনো সেই দিনের কথা'.... পিনাক বিশ্বাস


No comments