অগ্নিযুগের বিস্মৃত দেশপ্রেমিক চারুচন্দ্র বসু
১৯০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। মামলার তদন্ত প্রায় শেষ। বিচারও
প্রায় শেষের পথে। শীর্ণকায় শ্যামবর্ণ যুবক জানেন তাঁর অপরাধের শাস্তি হল ফাঁসি। কিন্তু
ছেলেটি নিরুত্তাপ। নিজের কৃতকর্মের জন্য কোনো অনুতাপ নেই। কিছুদিন পরেই ফাঁসিকাঠে
উঠতে হবে, বোঝা
দুষ্কর হাবভাব দেখে। মামলার বিচারপতি আলিপুর কোর্টের বিচারক এফ.আর.রো !
- তোমার
আর কিছু বলার আছে ?
- না কিছুই আমি চাইনে। সেশন-টেশনের প্রয়োজন নেই। বিচার করে কালই আমাকে ফাঁসি দাও। এটা ভবিতব্য যে, আশু বাবু আমার গুলিতে নিহত হবেন এবং আমি ফাঁসি কাঠে প্রাণ দেব।
আদালতের কার্যবিবরণী শেষ হয় ১৯০৯ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারী।
হাইকোর্টে আপিল করা হলেও ভবিতব্য ছিল মৃত্যুদণ্ডই। কারাবাসকালীন নির্যাতন সহ্য
করেছিলেন অকথ্য। কিন্তু তাঁর সহকর্মী এবং সংগঠন সম্পর্কে একবিন্দু তথ্য তিনি মুখ
থেকে বের করেননি। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোন রকম অনুকম্পা
প্রার্থনা করেননি। বরং সর্বদা নিজের আদর্শের প্রতি সুগভীর আস্থা রেখেছিলেন।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন ধার্য হয়েছিল ১৯০৯ সালের ১৯ শে মার্চ।
স্থান আলিপুর কেন্দ্রীয় জেলখানা। "ফাঁসির
মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান"-এর দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হল তাঁর নাম। ক্ষুদিরাম
বসু , কানাইলাল
দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ
বসুর পর তিনিই ছিলেন চতুর্থ বাঙালি বিপ্লবী যিনি ফাঁসিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন।
আলীপুর ও মুরারীপুকুর বোমা হামলাসহ অন্যান্য মামলার ইংরেজ
সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন আশুতোষ বিশ্বাস। এই মামলায় সরকার পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি
ছিলেন নর্টন। আশুবাবুর ছিল ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং দুর্দমনীয় সাহস। তিনি সক্রিয়ভাবে
বিভিন্ন বিপ্লবীর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের
সহায়তা করতেন। ফলত তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনে ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ক্রমেই বঙ্গজ বিপ্লবীদের ত্রাস হয়ে উঠলেন আশুবাবু। এ হেন আশুবাবুকে
কৃতকর্মের ফল পেতেই হবে।
কিন্তু করবে কে কাজটা?
চারুচন্দ্র বসু। জন্ম ১৮৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খুলনা
জেলার শোভনা গ্রামে। পিতা কেশবচন্দ্র বসু। চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় চারু বসু। ছিলেন জন্মগত
শারীরিক প্রতিবন্ধী। ডানহাতে কোন তালু নেই ,
নেই কোন আঙ্গুল। ছিপছিপে পাতলা গড়ন। স্বভাবে ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষুরধার ও
প্রতিবাদী। চারু হাওড়ায় একটি প্রেসের সাধারণ কর্মী ছিলেন। চারুর দাদা শৈলেন্দ্রনাথ
বসু বগুলা স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক ছিলেন। চারু নিজে কলকাতার রসা রোডে বাড়ি ভাড়া
নিয়ে থাকলেও প্রায়ই বগুলা যেতেন।
সেই সময় বাঘাযতীন কলকাতা থেকে কুষ্ঠিয়া যাতায়াত করতেন। বগুলা ছিল কলকাতা থেকে কুষ্ঠিয়ার
মধ্যবর্তী একটি স্টেশন।
তাই বাঘাযতীনের সাথে খুব সম্ভবত তাঁর যোগাযোগ ছিল। যদিও পুলিশের রিপোর্টে কোন
নেতাকেই চারুর মন্ত্রনাগুরু বলা হয়নি।
১৯০৯ সালের ১০ ই ফেব্রুয়ারি। সাধারণ গ্রাম্য যুবকের বেশ
চারুর। তাঁর
পঙ্গু ডান হাতে খুব শক্ত করে বেঁধে নিলেন লজঝড়ে ওয়েবলি মার্ক ফোর রিভলবার বেঁধে
নিলেন। গায়ে চাদর। সকাল সকাল পৌঁছে গেলেন সুবারবান ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত প্রাঙ্গণ।
অপেক্ষা করতে লাগলেন আমজনতার ভিড়ে। সাজ এত নিখুঁত হয়েছে, সন্দেহ করার
কোন কারণ খুঁজে পায়নি আদালতের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো সার্জেন্ট। কিন্তু না দেখা পাওয়া
গেলো না আশুবাবুর।
বিকেল চারটের দিকে আদালতের পশ্চিম পাশে চারু দেখতে পেলেন
আশু উকিলকে। ছুটে গেলেন তরুণ চারু। যমদূতের মত দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। কেউ কিছু বুঝে
ওঠার আগেই বাম হাত দিয়ে নির্ভুল নিশানায় ট্রিগার চাপলেন চারু। বুলেট ভেদ করল শরীর।
লক্ষ্যভেদ, আদালতেই
সম্পন্ন আশু-নিধন।
কাজ শেষ। চারু প্রানপন ছুটলেন। কিন্তু কিছুদূর
যাওয়ার পরেই ঘিরে ফেলে পুলিশ। বিচারের নামে প্রহসন করে ব্রিটিশরা। জেলে অকথ্য
অত্যাচার চলে তাঁর উপর। খুব দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয়েছিল তাঁর বিচারপর্ব। ১৫ ই
ফেব্রুয়ারী আলিপুর কোর্টের বিচারক এফ.আর.রো তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ১৯০৯
সালের ১৯ শে মার্চ মাত্র ২০ বছর বয়সে ফাঁসি হয়ে যায় চারুচন্দ্র বসুর। আশুতোষ
বিশ্বাসকে চারুচন্দ্র বসু দ্বারা গুলি করে হত্যা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রগুরু
সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন,
" রাজনীতি ক্ষেত্রে তিনি(আশুতোষ বিশ্বাস) আমাদেরই দলভুক্ত
ছিলেন....। এটা একটা অদৃষ্টের পরিহাস যে এইরকম একজন লোককে অ্যানার্কিস্ট উপদ্রবের
বলি হতে হয়েছে।"
চারুচন্দ্র বসুর বিবাহ হয়েছিল তেরো বৎসর বয়স্ক বালিকা
কিরনবালার সঙ্গে। ১৬ ই ফেব্রুয়ারি আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের কনডেমনড সেল থেকে তাঁর
দুই সহোদর প্রতাপচন্দ্র বসু ও শৈলেন্দ্রনাথ বসু এবং শ্যলক ছত্রধারী বসুকে চিঠি
লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে কোথাও তিনি নিজের জীবনের অন্তিম মুহুর্ত আসন্ন বলে কোন
আক্ষেপ করেনি কিন্তু সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কিরনবালা সম্পর্কে অন্তহীন আক্ষেপ
করেছিলেন। শ্যলক ছত্রধারীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, "আর কয়দিন পরে আমার অস্তিত্ব জগৎ
হইতে লোপ পাইবে - তাহাতে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত নই। কেবলমাত্র একটির জন্য
দুঃখিত। একটি অভাগিনী তেরো বৎসর বয়স্কা বালিকাকে দীনহীন অবস্থায় এই সংসার সমুদ্রে
ভাসাইলাম। কিন্তু আশান্বিত প্রানে আজ তাহাকে আপনাদের কাছে অর্পন করিলাম। তাহার
প্রতি যেন আপনাদের দৃষ্টি থাকে।" কিরণবালার কাছে আজীবন যাতে চারুর স্মৃতি
অম্লান থাকে তার জন্যে আশুতোষ হত্যার কিছুদিন আগে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার হপ সিংহের
কাছ থেকে নিজের ফটো তুলে গ্রামের বাড়িতে কিরণবালার সাথে দেখা করে এসেছিলেন চারু। কিরানবালা
সেই ছবি আঁকড়ে কতদিন বেঁচেছিলেন তা আমরা কেউই জানি না।
চারু একা নন। তাঁর মত এমন যে কত নাম-না -জানা, না-দেখা, না-চেনা... যাঁরা
অগ্রপশ্চাৎ ভাবেননি দেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন বাজি রাখার আগে, যাঁদের ছিল
না অমরত্বের প্রত্যাশা,
ছিল না ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার সুপ্ত বাসনা। যাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে
ধারাবাহিক কার্পণ্য করেছে ইতিহাসও। প্রত্যাশিত পরিণাম, বিস্মৃতি।
কেউ মনে রাখেনি,
কেউ মনে রাখে না ?
তথ্যসূত্র-
উইকিপিডিয়া, অগ্নিযুগের
ফাঁসি (শুভেন্দু মজুমদার)
Post a Comment