Header Ads

একজন সাহসী বিপ্লবী নারী তথা বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরার প্রাণ বিসর্জনের ইতিহাস


বর্তমানের বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মেদিনীপুরের তমলুকের সন্তান ড. মণি ভৌমিক তখন খুব ছোট।তাঁর বাবা গুণধর ভৌমিক ছিলেন গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের একনিষ্ঠ সৈনিক।গুণধরবাবু একদিন পুলিশের নজর এড়িয়ে গভীর রাতে লুকিয়ে বাড়িতে এলেন।তাঁর সঙ্গে এক দরিদ্র মাঝবয়সী বিধবা মহিলা।গুণধরবাবুর প্রেরণায় এই বিধবা মহিলা স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশ্বস্ত সৈনিকে পরিণত হয়েছেন।১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন।হতদরিদ্র ঘরের মেয়ে তিনি।তাঁর বাবা বিয়ের পণ জোগাড় করতে পারেননি।তাই বারো বছর বয়সে ষাট বছরের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হলো তাঁর।সেটাও আবার দ্বিতীয়পক্ষের বিয়ে।মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিধবা হলেন তিনি।সৎ ছেলে তাঁকে বাড়ি থেকে দূর করে দিল।তিনি একটি ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়ে পরের বাড়িতে ধান ভেনে পেট চালাতে লাগলেন।আর গান্ধীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।


বিশ্বাস, সাহস আর দেশপ্রেমের প্রতীক এই মহিলাই হলেন 'গান্ধীবুড়ি' মাতঙ্গিনী হাজরা।

মণি ভৌমিক পরবর্তীকালে বলেছিলেন, “তাঁর বাবার বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না।তিনি আঠারো বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পরে ধান ভাঙার কাজ করে, একটি ঝুপড়ির মধ্যে থেকে তাঁর জীবন ধারণ করতেন।আমি তখন হাড় জিরজিরে নিঃসঙ্গ গরিব এক বালকমাত্র।কিন্তু স্নেহমমতার দৃপ্ততায় এবং দীপ্ততায় মাতঙ্গিনী হাজরা হয়ে উঠেছিলেন আমার বন্ধু এবং উপদেষ্টা।

মাতঙ্গিনী হাজরার জন্ম ১৮৭০ সালে তমলুক থানার হোগলা গ্রামে।বাবা ছিলেন গরীব কৃষক ঠাকুরদাস মাইতি।বাবা ঠাকুরদাস মেয়েকে ডাকতেন মাতুবলে।বারো বছর বয়সে মাতঙ্গিনীর বিয়ে হয় আলিলান গ্রামের ত্রিলোচন হাজরার সঙ্গে।১৮৮৮ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি স্বামীহারা হন।সাধারণ কৃষক বাড়ির সন্তানহীনা, নিরক্ষর, বাল্যবিধবা ছিলেন তিনি।থাকতেন তাঁর স্বামীর বাড়ির এক গোলাঘরে।কিন্তু এরপর সৎ ছেলে তাঁকে বের করে দেন। ১৯৩০ সালে গান্ধীজির ডান্ডি অভিযান ও লবণ আইন আন্দোলন মাতঙ্গিনীকে অনুপ্রাণিত করেছিল দেশসেবা ও জনসেবার মহান ব্রতে।তিনি নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে দেশ ও দেশের মানুষের কাজে।গান্ধীজির মতোই সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন মাতঙ্গিনী।তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন গান্ধীবুড়ি
১৯৪২ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর।বেলা তিনটে।পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য নিবেদিত বিপ্লবী জনতার মিছিল চলছে এগিয়ে তমলুক থানা ও দিওয়ানি আদালতের দিকে।তমলুক শহরের চারটে প্রধান প্রবেশপথে সেই মিছিল আটকানোর জন্য মোতায়েন করা হয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ।বিপ্লবীদের মুখে স্লোগান, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’, ‘বন্দেমাতরম’, ‘গান্ধীজি কি জয়।মেদিনীপুরের তমলুক শহরের উত্তর দিকের গ্রাম হোগলা, আলিনান, জ্যামিট্যা, সোয়াদিঘি, খোসখানা, ডিমারী, বিশ্বাস, ধলহারা, মথুরি, সিউরি থেকে দলে দলে সাধারণ মানুষ রূপনারায়ণ নদের পাড় ধরে হেঁটে আসছে স্লোগান দিতে দিতে।সারা শরীরের রক্ত ফুটতে শুরু করেছে জনতার।পায়রাটুঙ্গি খালের কাছে দেওয়ানি কোর্টের পেছনে বানপুকুর পাড়ে বিশাল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অহিংস জনতার মিছিলের পথ আটকে দাঁড়াল।আর এগোলেই গুলি করা হবে।এগোনো চলবে না।উদ্যত বন্দুকের সামনে তখন আগুনময় উদ্বেলিত জনতা।হঠাৎই মথুরি গ্রামের ১৩ বছরের ছোট্ট রোগা বালক লক্ষ্মীনারায়ণ দাস ছুটে গিয়ে এক ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে উত্তেজিত হয়ে ছিনিয়ে নিতে গেল নেট বন্দুক।সেই ছোট্ট বালককে পুলিশের বীরপুরুষরা বন্দুকের বাঁট আর বেয়োনেট দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে খোঁচা মেরে মেরে খুন করে ফেলল। মৃত্যুযন্ত্রণার বুকচেরা চিৎকার-আর্তনাদ কিছুটা হতচকিত করে ফেলল জনতাকে।

ঠিক তখনই সেই মিছিলের মধ্যে থেকে লোকজন ঠেলে এগিয়ে এলেন ৭৩ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা।সামনের একজনের হাত থেকে একটা ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন।সামনের একটা বাড়ির দালানে উঠে হতচকিত জনতাকে আহ্বান করে বললেন, “হয় জয়, না হয় মরণ।হয় এগিয়ে যাব নয় মরব।আমি সকলের আগে থাকব।কেউ পিছিয়ে যেও না।এসো।আর যদি কেউ না আসো তবে আমি একাই এই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাব। তাতে যদি মর্তে হয় মরব। এসো আমার সঙ্গে।

দেশমুক্তির এক অদম্য জেদ এই বৃদ্ধার অন্তরে-বাহিরে।সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকের পুলিশের হুমকি, “খবরদার, এক পা এগোলেই গুলি করব।যদিও সেই হুমকি টলাতে পারেনি এই তেজস্বিনী বৃদ্ধার গতিপথ।তাঁর লক্ষ্য পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন, দেশের স্বাধীনতা, একমাত্র স্বাধীনতা।অকুতোভয় সেই বৃদ্ধা বন্দেমাতরম বলতে বলতে এগিয়ে চললেন।

হঠাৎ একটি গুলি ছুটে এসে বিঁধল তাঁর বাম হাতে।তবু দৃপ্ত পায় এগিয়ে চলতে লাগলেন বৃদ্ধা, অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও পতাকাটিকে ডান হাতে আঁকড়ে ধরে বানপুকুরের পাড় ধরে।

ব্রিটিশের সেনাবাহিনী আবার গুলি চালাল বৃদ্ধার শরীর লক্ষ করে এবং বৃদ্ধার ডান হাতে গিয়ে বিদ্ধ হল সেই গুলি।রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেশমাতৃকার সেই বীরাঙ্গনার পরনের সাদা থান কাপড়টা।গুলিবিদ্ধ জখম দুটি হাত দিয়ে বুকের মাঝে পতাকাদণ্ডটি সন্তানকে আঁকড়ে ধরে রাখার মতো সজোরে ধরে রেখে বৃদ্ধা এগিয়ে চলেছেন, মুখে বন্দেমাতরম। রক্তের স্রোত বইছে সারা শরীরে, লাল রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে পরাধীন দেশের মাটি। বৃদ্ধার কণ্ঠে তবু সেই মুখরিত উচ্চারণ বন্দেমাতরম’, ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো। রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে দুহাতে দেশের পতাকাটি বুকে আঁকড়ে ধরে বীর দর্পে পরাধীন ভারতবর্ষের বীরমাতৃকা এগিয়ে চলেছেন।

ব্রিটিশ শাসকের অমানবিক পুলিশকর্মী বিস্মিত, ভীত।তাই তারা আরও ন্যক্কারজনক ঘৃণ্য হিংস্রতার পরিচয় দিল।আবার চলল গুলি।সেই গুলি গিয়ে বিদ্ধ হল সেই অহিংসার প্রতীক প্রবীণা মহীয়সীর কপালের কাছে বাঁ চোখের নীচে।গুলিটা তাঁর মাথার খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে গেল।আগ্নেয়গিরির মতো শত সহস্র কোটি ধারায় ছিটকে পড়ল রক্তের বন্যা।মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।তখনও তাঁর বুকে চেপে ধরা সেই পতাকাটি।রক্তে ভিজে উঠেছে ত্রিবর্ণ পতাকা।নিথর হয়ে পড়ে রইলেন গান্ধীবুড়ি’, ‘বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা

সে দিন মাতঙ্গিনী হাজরা ছাড়াও ব্রিটিশের গুলিতে তমলুকের মাটি লাল হয়েছিল মথুরি গ্রামের লক্ষ্মীনারায়ণ দাস, দ্বারিবেরিয়ার পুরীমাধব প্রামাণিক, মাশুরির জীবনকৃষ্ণ বেরা, আলিনানের নগেন্দ্রনাথ সামন্ত, ঘটুয়ালের পূর্ণচন্দ্র মাইতি, তমলুকের নিরঞ্জন জানা, কিয়াখালির রামেশ্বর বেরা, হিজলবেড়িয়ার নিরঞ্জন পাখিয়াল, খনিকের উপেন্দ্রনাথ জানা ও ভূষণচন্দ্র জানা এবং নিকাশীর বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী-সহ বারোজন দেশপ্রেমিক শহিদের তাজা রক্তে।

আজ থেকে ৭৭ বছর আগে মেদিনীপুরের মাটিতে এক বীরাঙ্গনা অকুতোভয় মহীয়সী নারীর যে দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগ দেখেছিল ব্রিটিশ শাসক, তাতে তারা উপলব্ধি করেছিল, এ দেশে আর বেশিদিন তাদের অত্যাচার চলবে না।মাত্র পাঁচ বছর পরেই ভারত ছেড়ে তাদের চলে যেতে হয়েছিলভারতবর্ষ পেয়েছিল স্বাধীনতার আস্বাদন।শহীদমাতৃকা মাতঙ্গিনী হাজরার বলিদানের আজ ৭৭তম পবিত্র বছরে এবং দিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা বলতে পারি-ওগো আমাদের বীরব্রতী শহিদ জননী, মাতঙ্গিনী তোমার আঁচলে বাঁধা রয়েছে যুগযুগান্ত ধরে বাঁধা থাকবেই আমাদের জন্ম জন্মান্তরের রক্ত ঋণ, যা অপরিশোধ্য চিরকাল, চিরদিন।


তথ্য-উইকিপিডিয়া, খবর অনলাইন


No comments