বিয়ের পর স্বামীর উপাধি নিয়ে তার নাম হলো হরিপ্রভা তাকেদা। শশীভূষণ মেয়ে-জামাইকে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। ওনার সহযোগিতায় জাপানি জামাই ঢাকায় গড়ে তোলেন 'ইন্দো-জাপানিজ সোপ ফ্যাক্টরি' নামে একটি সাবানের কারখানা। কিন্তু বছর খানেক চলার পর বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। ব্যবসা গুটিয়ে উয়েমন সস্ত্রীক তখন জাপান চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হরিপ্রভা-উয়েমন দম্পতির জাপান যাত্রার খবরে চারদিকে রীতিমত হৈ চৈ পরে গেলো।
চার মাস জাপানে কাটিয়ে তারা দুজনে ঢাকায় ফিরে আসেন। দু'বছর পর ১৯১৫ সালে হরিপ্রভা তার জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন যার নাম 'বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা'। ৬১ পৃষ্ঠার বইটির দাম ছিল চার আনা! ছাগল-ভেড়া আর শুঁটকি মাছের সঙ্গে জাহাজের দিনগুলি, এসরাজ বাজানো, শ্বশুরবাড়ির আতিথেয়তা, ভালবাসা, 'ইন্দোজেন'(ভারতীয় মহিলা)-কে নিয়ে জাপানিদের ঔৎসুক্য, সেখানকার জীবনযাত্রা এ সব কিছুই তিনি তুলে ধরেন বইটিতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যান হরিপ্রভার চার বছর পর ১৯১৬ সালে। আর তার লেখা 'জাপানযাত্রী' বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। সে হিসেবেও হরিপ্রভার বইটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ বইটি লেখার জন্য পরবর্তীতে 'প্রবাসী' সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, কবি বুদ্ধদেব বসু ও লেখিকা প্রতিভা বসু হরিপ্রভা তাকেদার অনেক প্রশংসা করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জাপান সরকার ভারত থেকে সব জাপানিকে দেশে ফিরিয়ে নেয়। স্বামী উয়েমেন তাকেদার সাথে হরিপ্রভাও তখন দ্বিতীয়বারের মত জাপান যান। সেটা ১৯৪১ সাল। যুদ্ধবিদ্ধস্ত জাপানে গিয়ে হরিপ্রভা পড়লেন অথৈ সাগরে! স্বামীর দিকের আত্মীয়-স্বজন সব ছন্নছাড়া,ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে বোমায়। না আছে থাকার জায়গা না কোন রোজগার। তার উপর স্বামী উয়েমেন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
বিপদের দিনে এগিয়ে আসলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। সে সময় তিনি টোকিও তে ছিলেন। হরিপ্রভা রাসবিহারী বসুর সহযোগিতায় টোকিও রেডিও-তে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ'-এর হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠের চাকুরী পান। তাঁর মাধ্যমেই পরিচয় হয় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সাথে৷ এই সাক্ষাৎকার ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড়। যে চাকরী একদিন নিয়েছিলেন জীবন বাঁচানোর তাগিদে, সেই চাকুরীই পরে করেছেন প্রবল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, জীবনের তোয়াক্কা না করে। জাপানের অন্যান্য শহরের মত টোকিও শহরও তখন মিত্র বাহিনীর মূহুর্মুহু বোমা বর্ষণে কেঁপেকেঁপে উঠছে, যখন-তখন যেখানে-সেখানে বোমা পড়ছে। বোমা হামলার ভয়ে রাতে কেউ আলো জ্বালাতো না। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারমধ্যে সেই বিধ্বস্থ টোকিও শহরের রাস্তা দিয়ে দুঃসাহসী এই বাঙালি বধূ হেঁটে হেঁটে রেডিও স্টেশনে যেতেন। আঘাত থেকে বাঁচার জন্য মাথায় থাকতো শুধু একটা হেলমেট। এভাবেই এই বীরাঙ্গনা নিজের জীবন বিপন্ন করে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত টোকিও রেডিও-তে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ'-এর সৈনিকদের জন্য বাংলায় খবর পাঠ করে গেছেন।
পরাজিত ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান ছেড়ে স্বামীকে নিয়ে ১৯৪৭-এ ভারত ফেরেন হরিপ্রভা, ওঠেন জলপাইগুড়িতে বোনের বাসায়। স্বামীর মৃত্যুর পর বোনপোর সাথে চলে আসেন কলকাতায়। নিজের পরিচয় দিয়ে সরকারি সাহায্যের প্রত্যাশী হননি কোনদিন। আজাদী সেনাবাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষ যোগ থাকায় কোনও সরকারও সেদিন বাড়ায়নি সাহায্যের হাত !
এলো ১৯৭২ সাল .……..
যে কলকাতা শহর থেকে একদিন নববধূর বেশে জাহাজে যাত্রা করেছিলেন শ্বশুরবাড়িতে, সেখান থেকেই সংস্কার মুক্ত আধুনিক এই বঙ্গনারী রওয়ানা হলেন মহাপ্রস্থানের পথে !
এপার বাংলা তাকে মনে না রাখলেও হরিপ্রভার জাপান যাত্রার শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ২০১২ সালে ওপার বাংলার চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন যার নাম 'জাপানি বধূ'।
তথ্যসূত্র : হরিপ্রভা তাকেদা"। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। প্রথম খন্ড (চতুর্থ সংস্করণ)। সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত। "রবীন্দ্রনাথের আগে জাপান জয়ী!"। আপেল মাহমুদ কালের কন্ঠ।
Post a Comment