“ধন্যি ছেলে, দেখিয়ে গেছে আমরাও জবাব দিতে জানি"
১৯৩০ সালের ২৯শে আগস্ট দিনটা ছিল শুক্রবার।ঘড়ির
কাঁটা সকাল নয়টা ছুঁই ছুঁই।ঢাকা মেডিক্যাল স্কুল এবং হাসপাতালে আর পাঁচটা দিনের
মতই একটি কর্মব্যস্ত দিন।হাসপাতালের সর্বত্রই নিকটবর্তী জেলাগুলির থেকে আসা
রোগীদের এবং রোগীদের আত্মীয়স্বজনের থিকথিকে ভীড়। অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে-বেরচ্ছে।স্ট্রেচারে করে রোগীদের এক
বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে নিয়ে ছুটছেন হাসপাতালের কর্মীরা।আর মেডিক্যাল কলেজের
পড়ুয়াদের আসাযাওয়া তো লেগেই আছে।যদিও আজ সকাল থেকেই হাসপাতালের নিরাপত্তা বেশ
আঁটোসাঁটো।আজ সকাল নটার সময় পুলিশের আই জি মিস্টার লোম্যান আর তার সহকারী মিস্টার
হাডসন নৌ-বিভাগের অসুস্থ পুলিশ সুপার মিস্টার বার্ডকে দেখতে আসবেন।তাই নিরাপত্তায়
ঢিলেমি একদম বরদাস্ত নয় ব্রিটিশদের।চারিদিকে ঘোরাফেরা করছে পুলিশের সশস্ত্র
রক্ষীরা।সন্দেহভাজন মনে হলেই চলছে তল্লাশি।মিস্টার বার্ডের ওয়ার্ডে তখন পুলিশে
পুলিশে ছয়লাপ।মাছি গলার উপায় নেই।
মিস্টার লোম্যান আর তার
সহকারী মিস্টার হাডসন নির্দিষ্ট সময়েই হাসপাতালে এলেন।দেখা করলেন মিস্টার বার্ডের
সঙ্গে।সাক্ষাৎ এবং কুশল বিনিময় চলল মিনিট কুড়ি। এবার ফেরার পালা।বার্ডের ঘর থেকে বেরিয়েই বারান্দার শেষে
সিঁড়ি।নামবেন বলে সেই সিঁড়িতে সবে পা দিয়েছেন লোম্যান।দোতলার সিঁড়ির কোণ থেকে
নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন সাদামাটা ফতুয়া আর ধুতি পরিহিত এক যুবক। কেউ কিছু বোঝার আগেই গর্জে
উঠল যুবকের ৩২০ বোরের অগ্নিবর্ষী রিভলভার।দ্রাম!দ্রাম!দ্রাম!
প্রথম নিশানা অব্যর্থ।লক্ষ্যভেদ। বুলেট ভেদ করল শিরদাঁড়া।মুখ
থুবড়ে মাটিতে বসে পড়লেন লোম্যান।আর উঠলেন না।যুবকের দ্বিতীয় নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট
হল। গুলি লাগল হাডসনের কাঁধে।ক্ষতস্থানে
হাত চেপে বসে পড়লেন তিনি।সশস্ত্র রক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠলেন,
“There he is! Get him!” লোম্যানের ঠিক পেছনেই ছিলেন
ঢাকার সরকারি কন্ট্রাক্টর সত্যেন সেন।সত্যেন সেন চিনতে পারলেন যুবককে।তিনি আটকাতে
গেলেন যুবককে। যুবক একটা ঘুষি
মারলেন তাকে।ছিটকে পড়লেন সত্যেন সেন।ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত ব্রিটিশ পুলিশ।
আতঙ্কের
রেশ কাটিয়ে যখন তারা ওই যুবকের পিছনে ধাওয়া করলেন তখন বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেছে।যুবক
তখন ছুটছেন উল্কাবেগে। এই হাসপাতালের প্রত্যেকটা গলি, রাস্তা, ওয়ার্ড তাঁর নখদর্পনে। সে নিজেই যে এই কলেজের
চতুর্থ বর্ষের মেডিক্যালের মেধাবী ছাত্র।তাঁকে ধরবার আপ্রাণ চেষ্টা করল পুলিশ।কিন্তু
সে চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হল। যুবক তখন হাসপাতালের ছাদের কার্নিশের উপর দিয়ে ছুটছেন। তারপর সুকৌশলে সেই ছাদের
কার্নিশ বেয়ে লাফ দিয়ে নেমে গেলেন হাসপাতালের রাস্তায়।হাসপাতালের মেথর সুষেন তাঁকে
পালতে দেখে খুলে দিলেন পাঁচিলের ছোট দরজা।যুবক হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। সামনেই এক গৃহস্থের জলের
ট্যাঙ্ক।যুবক জলের ট্যাঙ্কের উপরে উঠলেন।তারপর ট্যাঙ্ক অতিক্রম করে ঢুকে পড়লেন
গৃহস্থের বাড়ির ভেতর।তারপর একেবারে সদর রাস্তায়।দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে যুবকের পায়ের জুতো
তখন ছিঁড়ে গেছে। রিভলভারে আর একটাও
গুলি নেই।জনবসতিপূর্ণ এই অঞ্চলে একমুহূর্ত সে নিরাপদ নয়।যুবক থাকতেন আরমানি টোলার
সামনে মেডিক্যাল মেসে।সেখানে ফিরে যাওয়া আরও ঝুঁকিপূর্ণ।ঠিক তখনই একটি ঘোড়ার গাড়ি
ছুটে আসছিল রাস্তা দিয়ে।হাত দেখিয়ে গাড়ি থামালেন যুবক।
- এই গাড়োয়ান ভাড়া যাবে?
- যাবনা ক্যান বাবু ?
আপনি যেইখানে বলবেন সেখানে
যাবু।
কই যাইবেন বাবু?
- বক্সীবাজার।
- নেন।
বইয়া পড়েন।
পাঁচগন্ডা পয়সা দিয়েন।
- ঠিক আছে।
চল।
ঘোড়ার গাড়ি যুবককে নিয়ে
ছুটে চলল বক্সীবাজার।পনেরো মিনিটের যাত্রাপথ।বক্সীবাজারে নেমেই ভাড়া মিটিয়ে যুবক
ছুটলেন মণি সেনের বাড়ি।মণি যুবককে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন।যুবক তাঁকে খুলে বলল সব
ঘটনা।সারা দিন মণি সেনের বাড়িতে আত্মগোপন করলেন যুবক।
সত্যেন সেনের কাছ থেকে পুলিশ
জানতে পারল ওই যুবকের পরিচয়।কলেজের ম্যাগাজিনে টেনিস টিমের দল থেকে যুবকের ছবি বের
করা হল।ছাপানো হল কয়েক হাজার কপি।ঢাকাসহ বাংলার সর্বত্র সেই ছবি ছেয়ে গেল।ছবির নিচে
লেখা - "লোম্যানের হত্যাকারী।হত্যাকারীকে ধরিয়ে দিতে পারলে মোট দশ হাজার টাকা
পুরস্কার।পরিচয় গোপন রাখা হবে।নিকটস্থ থানায় খবর দিন।" মরিয়া হয়ে উঠল পুলিশ।যুবককে ধরার জন্যে শুরু হল বাড়ি বাড়ি
তল্লাশি।ছাড় পেল না মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররাও।পুলিশের বেধড়ক মারে আহত হয়ে
হাসপাতালে ভর্তি হল বহু ছাত্র।কিন্তু খোঁজ মিলল না যুবকের।
এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে তা
ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে ছিল কল্পনাতীত।সাড়া পড়ে গেল আসমুদ্র হিমাচল। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় যুবকের বিক্রমে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, “ধন্যি ছেলে, দেখিয়ে গেছে আমরাও জবাব
দিতে জানি।" অকুতোভয় সেই যুবকের
নাম বিনয়কৃষ্ণ বসু।যদিও বিনয় বলেই সে সকলের কাছে পরিচিত।আজকের দিনেই ১৯০৮ সালে
জন্মগ্রহণ করেন বাংলার রাজপুত্র বিনয় বসু।
Post a Comment