Header Ads

কলকাতার মাটিতে পি.জি. হসপিটালে আবিষ্কৃত হয়েছিল মশা ম্যালেরিয়ার বাহক


লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে হেঁটে চিড়িয়াখানা গিয়েছেন কখনও কিংবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল অথবা রেসকোর্স? তাহলে জায়গাটা চিনতে মোটেও অসুবিধা হবে না আপনার। পি.জি. হসপিটাল-এর নাম শুনেছেন নিশ্চয়। চৌরঙ্গী রোডের পর বাঁদিকের ফুটপাত ঘেঁষে পি.জি. হাসপাতালের লৌহঘের। এখান থেকেই শুরু হাসপাতালের সীমানা। এগিয়ে যান আরও কয়েক পা। দেখবেন আপনার সামনে একটা লাল রঙের তোরণ, তাতে এক টুকরো সাদা পাথরে লিখিত কয়েকটি ছত্র। তোরণশীর্ষে কালো পাথরে খোদাই করা একটি আবক্ষ মূর্তি।



ছত্রে যা লেখা আছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায় - এই তোরণটি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরের ঐ ছোট্ট গবেষণাগারটিতে এক ভদ্রলোক একদিন আবিষ্কার করেছিলেন - মশা ম্যালেরিয়ার বাহক।

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন ওই ভদ্রলোকের নাম হল রোনাল্ড রস।

১৬৪০ সাল। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু। সেই পেরুর শাসক কাউন্ট সিনকোনের স্ত্রীর খুব জ্বর হলো। প্রথমে জ্বর তারপর বমি।অনেক ডাক্তার কবিরাজ এসেও কিছু করতে পারল না।এমন সময় স্থানীয় ইন্ডিয়ান (আমেরিকার আদিবাসীদের ইন্ডিয়ান বলা হয়) মহিলা এসে তার চিকিৎসা করলেন এবং সুস্থ করে তুললেন। তিনি এক বিশেষ গাছের ছাল বেঁটে ওষুধ তৈরি করেছিলেন।কাউন্ট কে সেই বিশেষ গাছের কথা বললেও তার নাম বা কোথায় পাওয়া যায় সেটা বলেননি।এরপর কাউন্ট নিজে পরবর্তী কয়েক বছরে সেই গাছটি খুঁজে বের করলেন এবং তার নাম অনুসারে নাম দিলেন সিঙ্কোনা।এই সিঙ্কোনা গাছের ছাল দিয়েই দীর্ঘদিন ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা করা হত।পরবর্তী সময়ে ১৮২০ সালে বিজ্ঞানী পেলটিয়ার ও ক্যাভেলতুর মিলে সিঙ্কোনা থেকে কুইনাইন নিষ্কাশনের পদ্ধতি বের করেন, ফলে ম্যালেরিয়ায় প্রতিরোধে আরও শক্তিশালী ওষুধ পাওয়া যায়।

প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্যের ঘটনা। বছরজুড়ে উৎসবমুখর থাকা শহর প্রাঙ্গনে আজ কোনও শোরগোল নেই। পুরো শহরের উপর যেন কোনো অশরীরী আত্মা ভর করেছে। এর আসল কারণ পুরো শহর তখন জ্বরের প্রকোপে কাঁপছে। এথেন্সের এমন কোনো ঘর বাকি নেই, যেখানে কেউ জ্বরে ভুগছিল না। বড় অদ্ভুত সেই জ্বর। কিন্তু হঠাৎ করে এই জ্বর হওয়ার কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে গ্রিক রাজ বদ্যি শহরের পশ্চিমের বিশাল ডোবা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন। নাকের উপর সাদা কাপড় চেপে তিনি সেদিকে আঙুল তুলে ইশারা করলেন। কিন্তু জ্বরের সাথে এই ডোবার সম্পর্ক কী? রাজবদ্যি তখন জানালেন, ডোবার পানি থেকে উঠে আসা বিষাক্ত বাতাসের প্রভাবে পুরো শহর জুড়ে মানুষ জ্বরের প্রকোপে ভুগছে।এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে রোগের নামও রাখা হয়েছে ম্যালেরিয়া, যার অর্থ বিষাক্ত বাতাস

প্রাচীনকালে পুরো পৃথিবীর মানুষের বিশ্বাস ছিল ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রধান কারণ বিষাক্ত জলীয় বাষ্প। কিন্তু বিজ্ঞান কোনো অমূলক মতবাদ কিংবা আন্দাজের উপর নির্ভরশীল নয়। শুরু হয় গবেষণা। শত বছরের একনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে একসময় বেরিয়ে আসে ম্যালেরিয়ার আসল রূপ। খুলে যায় মিথ্যা মুখোশ। আর সেই মুখোশ উন্মোচনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন দুই প্রজন্মের কিংবদন্তি বিজ্ঞানী চার্লস ল্যাভেরন এবং রোনাল্ড রস।

চীনের সম্রাট হুয়াং তি কর্তৃক সম্পাদিত চিকিৎসা বিষয়ক ঐতিহাসিক গ্রন্থ Nei Ching-এ প্রথম ম্যালেরিয়ার লক্ষণসমূহ একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। অপরদিকে ভারতবর্ষের এক সংস্কৃত পণ্ডিত The Compendium of Susruta নামক গ্রন্থে ম্যালেরিয়া রোগের কারণ হিসেবে কোনো বিষাক্ত পতঙ্গের যোগসূত্রতার সম্ভাবনা উল্লেখ করেন। কিন্তু ম্যালেরিয়া রোগের প্রকৃত কারণ, উৎস এবং প্রতিকার বের করতে ব্যর্থ হন তৎকালীন চিকিৎসকগণ।

চার্লস লুই আলফানসো ল্যাভেরন ১৮৪৫ সালের ১৮ জুন প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ফ্রান্স সামরিক বাহিনীর নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক। পিতার আদর্শে বড় হয়ে উঠা ল্যাভেরন তাই চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তিনিও ফ্রান্স সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীদের বিভিন্ন জটিল সমস্যা নিয়ে নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতেন ল্যাভেরন। ১৮৭৮ সালের ল্যাভেরনকে আলজেরিয়াতে বদলি করে দেওয়া হয়। ঘটনাক্রমে তখন আলজেরিয়া জুড়ে ম্যালেরিয়া মহামারি চলছিল। প্রতিনিয়ত শত শত রোগী হাসপাতালে এসে ভর্তি হতে থাকল। আর দিনভর চিকিৎসা করে অবসর সময়ে ল্যাভেরন রোগীদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করতেন। ১৮৮০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি এক রোগীর রক্তের নমুনাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ৪০০ গুণ বড় করে পরীক্ষা করছিলেন। তখন তিনি লোহিত রক্তকণিকার ভেতর বেশ অদ্ভুত কিছু বস্তু লক্ষ্য করেন। প্রাথমিকভাবে দেখতে অনেকটা ব্যাক্টেরিয়ার মতো মনে হচ্ছিল। গবেষক ল্যাভেরন কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে, এগুলো ব্যাক্টেরিয়া নয়। বরং এই জীবগুলো অন্য প্রজাতির কোনো জীবাণু।এর মাধ্যমে যেন হাজার বছরের অধরা রহস্য সমাধান করে ফেলেন তিনি। খুব দ্রুত তিনি এই আবিষ্কারের কথা জানিয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট পত্র প্রদান করেন। এভাবে ফরাসি সেনাবাহিনীর এক নিষ্ঠাবান ডাক্তারের হাত ধরে শুরু হয় ম্যালেরিয়ার জীবাণু Plasmodium-কে আবিষ্কারের যাত্রা।

চার্লস ল্যাভেরন যদিও ম্যালেরিয়া জীবাণু আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, কিন্তু ঠিক কীভাবে এই জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে, এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা অজ্ঞ ছিলেন। এমনকি ল্যাভেরনের ম্যালেরিয়া জীবনচক্রও অসম্পূর্ণ ছিল। এই অজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানকে উদ্ধার করতে দৃশ্যপটে হাজির হন বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস।

স্যার রোনাল্ড রসের জন্ম ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের আলমোড়া অঞ্চলে। তাঁর পিতা স্যার সি সি রস তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে সুশিক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁকে গ্রেট ব্রিটেনে ফেরত পাঠানো হয়। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন তিনি। যদিও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যায়ন করার কোন ইচ্ছা তার ছিল না। পিতার ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। জেনারেল সি সি রস স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর ছেলে ডাক্তার হয়ে ভারতীয় মেডিক্যাল সার্ভিসে চাকরি করবে।কর্মজীবনের শুরু থেকেই রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়া নিয়ে আগ্রহী ছিলেন।তিনি চার্লস ল্যাভেরন এবং প্যাট্রিক ম্যানসনের ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত জার্নাল নিয়ে কাজ করতেন। ল্যাভেরন তার এক জার্নালে ম্যালেরিয়ার সাথে মশার যোগসূত্র থাকার কথা ধারণা করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা নির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। রোনাল্ড রস ল্যাভেরনের প্রস্তাবিত তত্ত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিছুদিন পর রোনাল্ড রস ভারতবর্ষে বদলি হয়ে যান। পিতার স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে ইংল্যাণ্ডের মায়াত্যাগ করে তিনি বোম্বের জাহাজে উঠে পড়েন। তার পিছু পিছু ম্যালেরিয়ার ভূতও ভারতবর্ষে গিয়েছিল পৌঁছে।

তিনি সেখানে গিয়ে একটি অদ্ভুত পরীক্ষা শুরু করেন। তিনি বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী ম্যালেরিয়া রোগীর উপর এই পরীক্ষা শুরু করেন। প্রথমে তিনি সুরক্ষিত পরিবেশে মশার চাষ করেন। তারপর গবেষণাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তিনি তাদের উপর মশাগুলিকে ছেড়ে দেন। এই অভিনব পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি বেশ সমালোচিত হলেও তিনি থেমে যাননি। তিনি সেই মশাগুলোর দেহে ম্যালেরিয়া জীবাণু সন্ধান করতে থাকেন। প্রথম দুবছরে তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন। তবে ১৮৯৭ সালে তিনি রাতারাতি বেশ বড় আবিষ্কার করে ফেললেন।

সেবার রস কিছু দুর্লভ প্রজাতির মশার উপর পরীক্ষা করছিলেন। তখন তিনি মশাগুলোর পাকস্থলীতে এমন কিছু বস্তু লক্ষ্য করেন যার সাথে ম্যালেরিয়াস স্পোরোজয়েটের খানিকটা সাদৃশ্য রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ব্যর্থ হওয়া রস এবার আশার আলো দেখতে পান।কিন্তু ওদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে রসকে সতর্কবার্তা পাঠানো হলো। এরকম অদ্ভুত অনিরাপদ গবেষণা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য রসকে আদেশ প্রদান করা হলো। রস সরকারি আদেশ অমান্য করার দুঃসাহসিকতা দেখাননি। তিনি এবার মানুষের বদলে পাখির উপর গবেষণা শুরু করেন। এই ঘটনা তাঁর জীবনে শাপে বর হয়ে ধরা দিল।এবার রস আরো দ্রুত ম্যালেরিয়ার জীবনচক্রের অমীমাংসিত ধাঁধা সমাধান করতে সক্ষম হলেন।তিনি পাখির ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্র সম্পন্ন করার পর মানুষের ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্রের পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরি করেন। রস প্রমাণ করলেন, ম্যালেরিয়া ছড়ানোর পেছনে দায়ী প্রধান পতঙ্গ স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা। তাঁর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে রোনাল্ড রস "দ্য প্রিভেনসন অফ ম্যালেরিয়া" নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্যার রোনাল্ড রসকে ১৯০২ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়। তাঁর ভারতীয় সহ-গবেষক পাণিহাটি-নিবাসী ডাক্তার কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই কর্মের জন্য ব্রিটেনের সম্রাট এডোয়ার্ড স্বর্ণপদকে ভূষিত করেন। মজার ব্যাপার হলো, স্যার রস বিজ্ঞানী ল্যাভেরনের ৫ বছর পূর্বে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন।

১৮৯৭ সালের ২০শে আগস্ট পি জি হাসপাতালের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সার্জন প্রথমে খবরটা শুনতে পেল সহকর্মীরা। তারপর ক্রমে বিশ্ববাসী। মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার লক্ষ লক্ষ জ্বর-কাতর রোগী কাঁপতে কাঁপতে পেল পৃথিবীতে ম্যালেরিয়ার মৃত্যুদূতকে চিহ্নিত করে ফেলেছেন জনৈক মানবহিতৈষী। কোথায়? না, কলকাতায়। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে - ঐ ছোট্ট ঘরটিতে।



তথ্যসূত্র - দৈনিক ইত্তেফাক, রোর বাংলা


No comments