Header Ads

আজ কুখ্যাত ব্রিটিশ জেলাশাসক বার্জ হত্যার সেই ঐতিহাসিক দিন


১৯৩৩ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। মেদিনীপুর শহরের পুলিশ গ্রাউন্ড। সেদিন মহামেডানের বিরুদ্ধে টাউন ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ। খেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই লোকে লোকারণ্য। তিলধারণের স্থান নেই। খেলায় ব্রিটিশদের মধ্যে থেকেও কয়েকজন অংশগ্রহণ করবে। উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং জেলাশাসক বার্জ। তাই নিরাপত্তাও আঁটোসাঁটো। তাছাড়া মাঠের একদিকে জেলখানা, অন্যদিকে পুলিশ আরমারী। কার সাধ্য সে বেষ্টনী ভেদ করে মাঠে প্রবেশ করে। বার্জের গতিবিধি খুঁটিয়ে দেখার পর বিপ্লবীরা ঠিক করেছিল ২রা সেপ্টেম্বর ফুটবল মাঠেই সম্পন্ন হবে বার্জ নিধন। ঝুঁকিও প্রচুর, কিন্তু এ ছাড়া উপায় নেই। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। দুই অকুতোভয় যুবক সেদিনের সেই ফুটবল ম্যাচের দর্শকাসনে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন। রইল সুযোগের অপেক্ষায়। জোন্স, লিন্টন,স্মিথ, জঙ্গি কাপ্তান এরা আগেই মাঠে এসে গেছে। এখন অপেক্ষা শুধু জেলাশাসক বার্জের। 



দেখতে দেখতেই মাঠে এসে পৌঁছালো বার্জের গাড়ি। গাড়ির চারিদিকে উৎসাহী জনতার ভিড়। যদিও পুলিশ কাউকেই পাশে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। চারিদিকে সশস্ত্র দেহরক্ষী। গাড়ি থেকে তখন প্রথম পা রেখেছেন। হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে গর্জে উঠল যুবকের অগ্নিবর্ষী রিভলভার। দ্রাম!দ্রাম!দ্রাম!গুলি লাগল বার্জের বুকে। বসে পড়ল বার্জ।আর উঠল না। বাঁধা দিতে এল জোন্স।উত্তর দিক থেকে গর্জে উঠল অপর যুবকের অগ্নিবর্ষী রিভলভার। দ্রাম!দ্রাম!দ্রাম!গুলি লাগল জোন্সের পায়ে। বসে পড়লেন তিনি। মাঠে তখন তুলকালাম। প্রাণভয়ে লোকজন ছুটে বেরচ্ছে। হুলস্থুল কান্ড। হাসপাতাল থেকে তলব করা হয়েছে অ্যাম্বুল্যান্স। দুই যুবক চাইলে ভিড়ে মিশে যেতে পারতেন কিন্তু না তারা সে চেষ্টা করল না। বার্জকে ভূপতিত হতে দেখে তারা দুজনে বুকে চড়ে বসলেন বার্জের। রিভলভারের সবকটা গুলি বার্জকে উজাড় করে দিলেন একে একে। ফুটবল মাঠেই সম্পন্ন বার্জ নিধন। এদিকে সশস্ত্র পুলিশ গুলি চালাল অভাবিত ঘটনার ঘোর কাটিয়ে। তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই দুই যুবকের। তারা খুশি। তাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে। এবার পুলিশ যা খুশি করুক। পুলিশের গুলি লাগল দুই যুবকের পেটে। বীর কিশোরদ্বয় লুটিয়ে পড়লেন মাঠে। নিজের প্রাণ দিয়ে তাঁরা দেখিয়ে দিল মেদিনীপুর আজও জবাব দিতে ভোলেনি।

"No young whitemen volunteered to come down to Midnapore to take charge of this district." জেলাশাসক পেডি ও ডগলাসের মৃত্যুর পর এটাই ছিল সেইসময়ের মেদিনীপুরের বাস্তবতা। বিপ্লবীদের রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে। জবাব দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত মেদিনীপুরের বীর সন্তানেরা। আসুক সেনাবাহিনী। আসুক ব্রিটিশ ফৌজ। চালাক গুলি। ফাঁসি দিক। কিন্তু মেদিনীপুরের বীর সন্তানেরা পিছিয়ে যাবে না। জবাব তারা দেবেই। মৃত্যুকে তারা ভয় পায় না।এদিকে জেলাশাসক খুঁজতে তখন ব্রিটিশদের শোচনীয় অবস্থা। সবার মুখেই একই কথা। অন্য কোথাও চলে যাব কিন্তু মেদিনীপুর কিছুতেই না। অত বীরত্ব দেখিয়ে লাভ নেই। সবার আগে নিজের প্রাণ। বিস্তর খোঁজাখুঁজি চলল। শেষে এগিয়ে এলেন এক শেতাঙ্গ জেলাশাসক মিস্টার বার্জ।জেলাশাসক মিস্টার বার্জ বিপ্লবীদের হত্যার তালিকায় ঢুকে পড়বেন, প্রত্যাশিতই ছিল।

পেডি, ডগলাস হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ প্রশাসন আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা দিয়েছিল বার্জকে। বার্জ নিজেও ছিলেন বুদ্ধিমান।সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতেন সর্বদা। রাখতেন সশস্ত্র দেহরক্ষী। অপরিচিত কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হত না।নির্দিষ্ট রুটিন মেনে কিছু করতেন না।বাড়ি থেকে কার্যালয় যাতায়াতের সময় নির্দিষ্ট ছিল না।এমনকি বাড়ি থেকে কার্যালয় যাওয়ার পথ পরিবর্তন করতেন প্রায়ই।শখ বলতে শুধু একটাই– ফুটবল। এই ফুটবল খেলাই যে একদিন তার মৃত্যু ডেকে আনবে তা ঘুনাক্ষরেরও আঁচ করতে পারেনি বার্জ। 

কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল বার্জ নিধন-প্রস্তুতি।খুনের সিদ্ধান্ত নিলেই তো হল না, রূপায়ণের নীল নকশা নিখুঁত হওয়া জরুরি।আর বার্জের কাছেপিঠে ঘেঁষাই যথেষ্ট কঠিন ছিল। প্রশ্ন উঠল এই কাজের দায়িত্ব কে নেবে? বিভির তরফে বার্জ হত্যার দায়িত্ব পেলেন অকুতোভয় দুই যুবক। অনাথবন্ধু পাঁজা এবং মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। 

অনাথবন্ধু পাঁজার জন্ম ১৯১১ সালের ২৯ শে অক্টোবর। মেদিনীপুরের জেলার সবং থানার অন্তর্গত জলবিন্দুতে। পিতা সুরেন্দ্রনাথ পাঁজা। মাতা কুমুদিনী দেবী। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। পরিবারের সংকট চরমে পৌঁছায় যখন অনাথ মাত্র তিন বছর বয়সে তাঁর বাবাকে হারায়। সংসারের হাল ধরার মত তখন কেউ নেই। তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় ভুবন পালের পাঠশালায়।এরপর মায়ের সাথে অনাথ ও তাঁর ভাইয়েরা মেদিনীপুর শহরে চলে আসে। সেখানে অনাথ ভর্তি হয় সুযাগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর মেদিনীপুর টাউন স্কুলে ভর্তি হন। মেদিনীপুর টাউন স্কুলে পড়ার সময় বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এর সংস্পর্শে আসে অনাথ। সেখান থেকেই একাধিক দেশকে স্বাধীন করার ব্রতে উদ্বুদ্ধ হওয়া। দুর্দমনীয় সাহস ছিল বাইশ ছুঁই ছুঁই অনাথের। ছিল দেশের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা। কিছুদিন টাউন স্কুলে পড়ার পর বিভির নির্দেশে অনাথ ভর্তি হয় মেদিনীপুর টাউন স্কুল। কিন্তু অভাবের কারণে আর পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি। এই সময়েই বল্লভপুর জিমন্যাশিয়াম ক্লাবে অনাথ বিপ্লবী অমর চ্যাটার্জী ও বিপ্লবী ব্রজকিশোর চক্রবর্তীর সংস্পর্শে আসেন। হয়ে ওঠেন বিভির একনিষ্ঠ সদস্য। 

অনাথের মত বিভির অনেকেই তখন অ্যাকশনের জন্য মরিয়া। মূলধন বলতে শুধু আবেগ আর সাহস।দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ ছিল পূর্ণমাত্রায়। অনাথের দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় একটি ঘটনা থেকে। বিপ্লবীরাই তৎকালীন সময়ে নিজেরাই বিভির ব্যায়ভার বহন করত। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সকলে অর্থসাহায্য করত। কিন্তু অনাথের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। পিতৃহীন সংসারে দুবেলা ঠিকমত অন্নের সংস্থান হওয়াই দুষ্কর। অনাথের পরিবারের কিছু কৃষিজমি ছিল খড়্গপুরে। সেই জমিতে উৎপন্ন ধান বিক্রি করে যে সামান্য পয়সা আসত তা দিয়েই সংসার চলত। এক বছর ধান বিক্রি করে অনাথ বেশ কিছু টাকা উপার্জন করল। কিন্তু কোথায় কি!নিজের সংসারের জন্যে এক পয়সাও অনাথ সেইবার খরচ করল না। পুরো টাকাটাই তুলে দিল বিভির হাতে। মা তাঁকে প্রশ্ন করতে উত্তর দেয়-"ধান বিক্রি করার টাকা রাস্তায় পকেট মার হয়ে গেছে।" এমনই ছিল তাঁর চেতনা-নিজের মায়ের চেয়েও বড় দেশজননী। 

মৃগেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ১৯১৫ সালের ২৭ অক্টোবর মেদিনীপুরের জেলার সবং থানার পাহাড়িপাড়ায়।পিতা বেণীমাধব দত্ত।মৃগেন্দ্রনাথ মেদিনীপুর টাউন স্কুলের ছাত্র ছিল।পড়াশুনোয় কোনদিনই বিশেষ মনোযোগ ছিল না।বয়স তখন আঠারো ছুঁই ছুঁই। মেদিনীপুর টাউন স্কুলে পড়ার সময় বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের সংস্পর্শে আসে মৃগেন। দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। মেদিনীপুর গোপন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে যুক্ত হয়ে রিভলভার চালনা শেখার জন্য তিনি এবং অনাথ, নির্মলজীবন ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ও রামকৃষ্ণ রায় কলকাতায় যান। শিক্ষাশেষে পাঁচটি রিভলভারসহ তাঁরা মেদিনীপুরে ফিরে আসেন। বার্জ হত্যার প্রথম চেষ্টা করা হল ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসেই। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হল। সুযোগ আবার এল কিছুদিন পরেই। আর বাকিটা ইতিহাস। 



(স্বত্ব সংরক্ষিত-কপিরাইট-অভীক মণ্ডল)




No comments