খালি পায়ে বিপ্লব || দ্বিতীয় পর্ব || মোহনবাগানের অমর একাদশের অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি
শিল্ড ফাইনালের
মোহনবাগানের গোলকিপার হীরালাল মুখার্জি । উত্তর কলকাতার ছেলে । নৈহাটির কাছে একটি জায়গায়
ইটভাটায় কাজ করতেন। এত অল্প বেতন পেতেন
সংসার চালাতে পারতেন না। শিল্ড ফাইনালের দিন হীরালাল ম্যাচটি খেলবেন না ঠিক করেছিলেন। মায়ের অসুখ , ওষুধ কেনার পয়সা নেই। নিজের উপর ঘেন্নায় সেমিফাইনালের পর বেপাত্তা হয়ে যান। ফাইনালের দিন সকালে তাঁকে খুঁজে বের করেন তিনি,
দেন আত্মবিশ্বাস। তিনবার ট্রেডস কাপ জেতার জন্য একটা সোনার মেডেল পেয়েছিলেন হীরালাল, দিয়েছিলেন নাটোরের মহারাজা। সেই মেডেলটা বিক্রি করে মায়ের ওষুধ কিনবার চেষ্টায় ছিলেন হীরালাল । মেডেল বিক্রি করতে বারণ করেন তিনি। তিনি তাঁকে জোর করে দোকানে নিয়ে যান। ওষুধের দোকানী তাদের চিনতে পেরে দাম নেননি। সেই সম্মানটুকু আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেয়
হীরালালের। ফাইনালে মোহনবাগানের জন্য
মরে যেতেও প্রস্তুত ছিলেন সেদিন হীরালাল মুখার্জি।
আর যিনি তাঁকে খুঁজে
বের করেছিলেন তিনি ছিলেন মোহনবাগানের অমর একাদশের অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ি।
১৯১১ সালের শিল্ড
টুর্নামেন্টের জন্য মোহনবাগান ক্লাব তাদের সেরা দল তৈরি করেছে। নিজেদের প্রস্তুতি
সম্বন্ধে খেলোয়াড়রা ও একান্ত অনুগত শীর্ষকর্তারা ছাড়া কাউকেই জানানো হয়নি। ১৯০৫
সালের গ্ল্যাডস্টোন কাপের ফাইনালে প্রথম দুটো গোল করা ‘পিছল্ বাবু’কে করা হলো টিমের ক্যাপ্টেন, তাঁর ওপরই দায়িত্ব দেওয়া হল এমন দল বাছার যা টুর্নামেন্ট জেতার লক্ষে মাঠে
নামবে। ক্যাপ্টেন কিন্তু দলে অনেকগুলো পরিবর্তন আনলেন। অভিলাষ ঘোষকে নিয়ে এলেন
সেন্টার ফরওয়ার্ডে, শ্রীশচন্দ্রকে আরেক ফরওয়ার্ড হিসেবে উঠিয়ে আনা
হলো, রাজেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তকে ফিরিয়ে দিলেন তাঁর পছন্দের মাঝমাঠ,
হীরালাল মুখার্জিকে দিলেন গোলরক্ষকের দায়িত্ব। ‘পিছল্ বাবু’র নির্দেশে তৈরি হলো নবীন দল, ৩০ বছরের বিজয়দাস ভাদুড়ি সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় সেই দলের।
সেই ‘পিছল্ বাবু' হলেন শিবদাস ভাদুড়ি। মোহনবাগানের সেই দলের অধিনায়ক। ১৯১১ সালের শিল্ড জয়ী মোহনবাগান দলে মাত্র এগারোজনই খেলোয়াড় ছিলেন। এঁরা প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তিনিই একে একে রত্ন গুলো সংগ্রহ করেছিলেন এবং দল তৈরী করেছিলেন।
আই এফ এ শিল্ড
ফাইনাল চলছে। বাকি আর দশ মিনিট। ১-০ গোলে এগিয়ে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট। আচমকা
শিবদাস ডান দিকে ছুটে গিয়ে লেফট ব্যাককে ডজ করে দুর্দান্ত একটা শট নিলেন। গোলকিপার ক্রেসি সম্পূর্ণ পরাস্ত হলেন। ফলাফল ১-১। খেলা শেষ হবার মাত্র দু মিনিট আগে শিবদাস একটি চমৎকার পাস দিলেন অভিলাষ ঘোষকে। অভিলাষ দু -জন ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষক কে কাটিয়ে
এগিয়ে গেলেন এবং হাঁটতে-হাঁটতে গোলে বল ঠেলে দিলেন। ফলাফল ২-১।
রয়টার সেই সময় রিপোর্ট
করেছিল - "যখন জানা গেলে যে, ইস্ট ইয়র্কশায়ার পরাজিত
হয়েছে, তখনকার অবস্থা ছিল একেবারে বর্ণনাতীত, বাঙালিরা উল্লাসে নিজেদের জামা ছিঁড়ে ফেলে পতাকার মতো শূন্যে নাড়ছিলেন।"
ভাদুড়ি পরিবারের
সঙ্গে মোহনবাগানের সম্পর্ক অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই। শিবদাসের বড় দুই দাদা দ্বিজদাস এবং রামদাস মোহনবাগানে খেলেছেন। আরেক দাদা বিজয়দাসও সেই সেই শিল্ড জয়ী দলের
অন্যতম নায়ক। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকায়
ভাদুড়িদের তখন সবাই চিনতেন। বাবা বিপ্রদাস ভাদুড়ি চাকরি সূত্রে পূর্ব বঙ্গ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন।
শিবদাসের জন্ম ১৮৮৭
সালের ৬ই নভেম্বর বরিশালে। খুব অল্প বয়সে বিপ্রদাস মারা যান, মায়ের হাতেই মানুষ
হন শিবদাস এবং বিজয়দাস। খুব দাপুটে মহিলা ছিলেন তিনি। পাড়ার লোকেদের ভাষায় বাঙ্গাল গিন্নি । মা চাইতেন না শিবদাস-বিজয়দাস ফুটবল
খেলুক। তবু লুকিয়ে ওঁরা ফুটবল
খেলতেন। এগারো সালে বিজয়দাস তখন
ব্যবসা করেন, তাঁর আফিমের দোকান ছিলো। শিবদাস অবশ্য চাকরী করতেন, বেলগাছিয়া পশু চিকিৎসালয়ে।
ছোটবেলা থেকেই ফুটবল
খেলার প্রতি অগাধ টান শিবদাসের। তাঁর চার দাদাই তখন খেলছেন মোহনবাগানের হয়ে,
তাদের কাছেই ফুটবলের হাতেখড়ি। কলকাতার স্কুলে ভর্তি হয়ে
পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, দাদাদের সাথে নিয়মিত ময়দানে
প্রশিক্ষণ নিতে চলে আসতেন সকাল বিকেল। ধীরে ধীরে দক্ষ ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে উঠতে
থাকেন তিনি। নিজের প্রচেষ্টা ও অনুশীলনের মাধ্যমে বল কন্ট্রোল ও ড্রিবলিঙের
অসাধারণ ক্ষমতা রপ্ত করেছিলেন।
বাড়ির চাতালে জল
ঢেলে শিবদাস তার উপর স্কিপিং করতেন রোজ ভোরবেলায়। পিছল চাতালের উপর শরীরের ভারসাম্য রাখার কৌশল আয়ত্ব করার জন্যে। এটা শিবদাসের আবিষ্কার। এই কারণেই তার নাম হয় পিছল বাবু। অভিনব কায়দায় শিবদাস বাড়ির ছাদে ড্রিবলিং প্র্যাকটিস করতেন। ফুলের টব নির্দিষ্ট দূরত্বে রেখে। নেতৃত্ব দেওয়ার এক অদ্ভুত গুণ আবিষ্কার করেছিলেন
শিবদাস। ফুটবলে জায়গা বদল করে খেলার
সুবিধা তিনি মাথায় ঢুকিয়ে দেন অন্য খেলোয়াড়দের।
মাত্র পনেরো বছর
বয়সে মোহনবাগান ক্লাবে ভর্তি হন, নিয়মিত খেলতে শুরু করেন ১৯০8
সাল থেকে। ১৯০৫ সালের গ্ল্যাডস্টোন কাপের ফাইনালে দুটো গোল
করে নজর কারেন সব্বার। ১৯০৬ সালে মোহনবাগান টিমের ক্যাপ্টেন করা হয় তাঁকে। ১৯০৯
এবং ১৯১০ সালে শিল্ডে হারের পর, ১৯১১ সালে নতুন করে নিজের
হাতে তৈরি করেন ‘অমর একাদশ’। প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ শক্তির সূর্য কখনও অস্ত যায় না, এমন গতানুগতিক ধারণাকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেয়েছিলো তাঁর সেই ‘অমর একাদশ’। নতুন করে ইন্ধন জুগিয়েছিল স্তিমিত হয়ে আসা
স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইকে। ১৯২২ সালে সরে আসেন ক্যাপ্টেনের পদ থেকে। ১৯১৩ থেকে
১৯১৫, খেলা চালিয়ে যান শ্রীশচন্দ্র (হাবুল) সরকারের
নেতৃত্বে। পরের তিন বছর খেলেন দাদা বিজয়দাস ভাদুরীর নেতৃত্বে। ৩১ বছর বয়সে ফুটবল
থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেন।
১৯৩২ সালের ২৬ শে
ফেব্রুয়ারী পুরীতে ভ্রমণে গিয়ে ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৪ বছরে বয়সে
পরলোকগমন করেন শিবদাস ভাদুড়ি। ২০০৩ সালে মরণোত্তর ‘মোহনবাগান রত্ন’ সম্মানে ভূষিত করা হয় শিবদাস ভাদুড়িকে।
ক্যালেন্ডারের পাতায়
সেদিন ২৯ শে জুলাই ১৯১১, ছিল শনিবার। ১৯১১ সালের ২৯শে জুলাইয়ের লড়াই আজও ফুটবল প্রেমীদের কিংবা বাঙ্গালির মনে উঁকি
দিয়ে যায়। ১৭৫৭-র পলাশী যুদ্ধে ডুবে
যাওয়া সূর্যকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো সেদিন কলকাতার ময়দানে। সেই নস্টালজিয়া আজও তাড়া করে ফেরে মোহনবাগানের সবুজ ঘাসের মাথায়, যে ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে অনেক ঘাম,অনেক রক্ত, অনেক চোখের জল।
বাংলার ফুটবল যতদিন থাকবে
শিবদাস ভাদুড়ি ততদিন থাকবে।
তথ্যসূত্র - দেবু দত্তের ব্লগ, উইকিপিডিয়া
Post a Comment