ভারতের প্রথম স্নাতকোত্তর মহিলা বাংলার চন্দ্রমুখী বসু
এই নারীর স্পর্ধা কম নয়! তৎকালীন সমাজে পুরুষরাই
ছিল বরেণ্য। সাহিত্য থেকে বিজ্ঞান সর্বত্র তাদের অবারিত বিচরণ। সেই মহলে একজন নারী
জায়গা করে নেবেন, তা কখনওই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সমাজ কী কয়,
তা নিয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর। এই নারী যেটা মনে করতেন,
সেই পথেই হাঁটা দিতেন। রাস্তা- চড়াইউতরাই কি দুর্গম,
তাঁর কাছে কখনও মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়ায়নি।
তাঁর প্রতিভার কাছে তৎকালীন সমাজ মাথানত করলেও
তাঁকে সাদরে গ্রহণ করতে পারেনি। সে সময় সমাজের দিকপাল ব্যক্তিদের সঙ্গে এক আসনে এই
বঙ্গ নারীর স্থান হবে, তা হজম করতে সময় লেগেছিল।
তাঁর জীবনযাত্রা নিয়ে প্রতি পদে পদে বিদ্রুপ, তামাসা চলত। কিন্তু তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য।
দেরাদুন তখন ছিল ইউনাইটেড প্রভিন্সেস এর
অন্তর্গত। নবাবি গন্ধমাখা এই শৈলশহরে
তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। বাবা ভুবনমোহন বসু খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। বড় মেয়ের নাম রেখেছিলেন চন্দ্রমুখী। রসরাজ অমৃতলাল বসুর সম্পর্কিত ভগিনী ছিলেন তিনি। তাদের আদি বাসস্থান ছিল হুগলির মহানদ এলাকা। চাকরি সূত্রে ভুবনমোহন চলে যান দেরাদুনে। চন্দ্রমুখী ও তাঁর ভাইবোনেদের পড়াশোনাও সেখানে। এ শহরে গোড়া থেকেই নানা
প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। শিক্ষার আলোকবৃত্তে থাকা ব্রাহ্মদের পাশে
কিছুটা গুটিয়েই থাকতেন নেটিভ খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে চন্দ্রমুখী।
তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা স্থানীয় নেটিভ ক্রিশ্চান
স্কুলে। সে সময় বেথুন স্কুল ছিল
শুধুমাত্র হিন্দু মেয়েদের জন্য। মিশনারি প্রতিষ্ঠানে হিন্দুদের ধর্মান্তকরণ করা হয়—এই অভিযোগ খণ্ডাতে এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাই কলকাতায় এসেও সেখানে চন্দ্রমুখী পড়ার সুযোগ পাননি। পরিবর্তে ভর্তি হন আলেকজান্ডার ডাফের ফ্রি চার্চ ইনস্টিটিউশনে। এখন যে প্রতিষ্ঠানের নাম স্কটিশ চার্চ কলেজ।
১৮৭৬ সালে চন্দ্রমুখী বিশেষ অনুমতি নিয়ে এফ.এ
পরীক্ষায় বসেছিলেন। তিনিই ছিলেন একমাত্র
পরীক্ষার্থিনী। বাকি সবাই
পরীক্ষার্থী। সবাইকে অতিক্রম করে প্রথম
হয়েছিলেন চন্দ্রমুখী। কিন্তু তিনি মহিলা। তাই তাঁর রেজাল্ট প্রকাশ করা হয়নি। আটকে রাখা হয়েছিল।
তার ঠিক দু বছর পরে ১৮৭৮ সালে এফ এ পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। এ বার আর আটকে রাখতে পারল না বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ বৈঠকের পরে স্বীকৃতি দেওয়া হল মহিলাদের মেধাকে। পরবর্তী স্তরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেলেন চন্দ্রমুখী এবং কাদম্বিনী দুজনেই। এরপর দুজনেই বেথুন কলেজে ভর্তি হন। ততদিনে অহিন্দু ছাত্রীদের জন্য দরজা খুলে
দিয়েছিল বেথুন স্কুল ও কলেজ। বেআইনি ভাবেই চন্দ্রমুখীকে সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকার করেছিলেন তত্কালীন
ব্রিটিশ সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বেথুন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডক্টর সুনন্দা ঘোষ। দীর্ঘ
দিনের লড়াই এবং বেথুন কলেজের প্রাক্তনী সংসদের উদ্যোগে ২০১৩ সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস পুরোনো নথিপত্র খতিয়ে দেখে চন্দ্রমুখীর
এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট তুলে দেন বেথুন কলেজের হাতে।
১৮৮৩ সালে একসঙ্গে স্নাতক হন চন্দ্রমুখী এবং
কাদম্বিনী দেবী। এরপর কাদম্বিনী চলে
যান মেডিক্যাল সায়েন্সের ছাত্রী হয়ে। চন্দ্রমুখী স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৮৮৪ সালে তিনি প্রথম মহিলা হিসাবে ইংরেজি
অনার্স সহ এম.এ পাশ করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম স্নাতকোত্তর মহিলা। বাংলার নারী শিক্ষার ইতিহাসে এটা একটা মাইলফলক।
দেশের প্রথম মহিলা হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে এমএ পাশ করার পর চন্দ্রমুখীকে এক সেট শেক্সপিয়র রচনাবলি উপহার দেন পণ্ডিত
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
যে প্রতিষ্ঠান একদিন তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সেই বেথুন
কলেজেই তিনি ১৮৮৬ সালে যোগ দিলেন অধ্যাপিকা হিসেবে। ১৮৮৮ সালে আলাদা হয়ে যায় বেথুন স্কুল ও কলেজ। বেথুন কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন চন্দ্রমুখী দেবী। দক্ষিণ এশিয়ায় তিনিই প্রথম মহিলা যিনি একটি
আন্ডার গ্র্যাজুয়েট উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েছিলেন।
বেথুন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষা হওয়া সত্ত্বেও নানা
সময় তাঁর সমালোচনা করেছে তত্কালীন সংবাদপত্র। ইন্ডিয়ান মিরর, ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জারের মতো পত্রিকায় তাঁর সংস্কারমূলক কাজের সমালোচনা শোনা
গিয়েছে। কলেজের মেয়েদের টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য
বাড়তি পোশাক ও জুতো চেয়ে নির্দেশিকা জারি করায় সমাজকর্তাদের কটাক্ষও শুনতে হয়েছে
তাঁকে। ১৮৯০ সালে ইন্ডিয়ান মিররে এমনই এক সমালোচনার কড়া জবাব দিয়েছিলেন চন্দ্রমুখী।
১৮৮৬ সালে কলেজের সুপার পদে যোগ দেওয়ার পর থেকে
কার্যত একা হাতে বেথুন কলেজকে গড়ে তুলেছেন চন্দ্রমুখী। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে
চিঠিচাপাটি চালিয়ে কলেজের জন্য বাড়তি টাকা আদায় করেছেন। ভবানী দত্ত লেনের রাজ্য
লেখ্যাগারে তাঁর সেই চিঠিপত্র আজও সংরক্ষিত।
১৯০১ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে চন্দ্রমুখী বেথুন
কলেজ থেকে অবসর নিয়ে দেরাদুনে ফিরে যান। দেরাদুনে ফিরে যাওয়ার পর ১৯০৩ সালে ৪৩ বছর বয়সে কেশবানন্দকে বিয়ে করেন
চন্দ্রমুখী। স্থানীয় জমিদার কেশবানন্দ মমগায়েন ছিলেন ভারতের প্রথম ফরেস্ট
কনজারভেটর।
দেরাদুনে চলে যাওয়ার পর আরও তেতাল্লিশ বছর
বেঁচেছিলেন চন্দ্রমুখী। প্রয়াত হন ১৯৪৪ সালে। কিন্তু তাঁর গৌরবোজ্জ্বল অতীত সম্পর্কে অন্ধকারেই রয়ে
গিয়েছেন দেরাদুনে তাঁর প্রতিবেশী এমনকি তাঁর উত্তরাধিকারীরাও।
তাঁর বাকি দুই বোন বিধুমুখী ও বিন্দুবাসিনীও
অত্যন্ত বিদুষী ছিলেন। দুজনেই ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছিলেন। ১৮৯০ সালে বিধুমুখী এবং তার পরের বছর বিন্দুবাসিনী বসু।
কলকাতায় শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে এমন গভীর ভাবে
জড়িয়ে থেকেও অবসরের পর নিজেকে পুরোপুরি সংসারে ঢেলে দিয়েছিলেন চন্দ্রমুখী। যৌবনে
সংসারধর্ম পালনের সুযোগ না হলেও সংসারের আকাঙ্ক্ষা হয়তো মনে পুষে রেখেছিলেন
স্বল্পভাষী চন্দ্রমুখী। কলেজের হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও কোথাও হয়তো তৈরি হয়েছিল
বিপুল শূন্যতা। হয়তো সে জন্যই আচমকাই, তাঁর বহু সাধের
বেথুন কলেজ ছেড়ে, কলকাতা শহরের কর্মব্যস্ততা
ছেড়ে, তিনি ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর
শৈশবের দেরাদুনে। চন্দ্রমুখীর নেতৃত্বাধীন বেথুন কলেজের মাঠে এক সময় ব্যাডমিন্টন
খেলতে আসতেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখায় রয়েছে বেথুন কলেজের
সবুজ মাঠের উচ্চকিত প্রশংসা। অথচ সেই চন্দ্রমুখীই দেরাদুনে ফিরে গিয়ে নিজেকে বিলীন
করে দিয়েছিলেন স্বামী-সংসারের আড়ালে। দেশের নারীশিক্ষা আন্দোলনের প্রথম সারিতে
ছিলেন তিনি। ঈশ্বরচন্দ্রের আশীর্বাদধন্য লাজুক চন্দ্রমুখী নিজেকে নিয়ে কখনও কিছু
লেখেননি।
দেশের প্রথম স্নাতক মহিলা হিসাবে দুই বঙ্গ নারীর
নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একজন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। আর একজন হলেন
চন্দ্রমুখী বসু। শুধু ভারতেই নয়, ব্রিটিশ অধিকৃত সব দেশগুলির
মধ্যে প্রথম স্নাতক মহিলা তাঁরা। এ সম্মান সত্যি ঈর্ষণীয়!
একজন শিক্ষিতা নারী তাঁর অঙ্গুলিহেলনে চালিত
করবে পুরুষসমাজকে, তৎকালীন সমাজে এটা মেনে নিতে চাইত না কেউ। সমাজের কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন দুজনেই। কিন্তু তাদের আটকানো যায়নি। বাংলার নারীরাও যে পড়াশোনায় কারও থেকে যে পিছিয়ে
নেই সেটা তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া, ডেইলি হান্ট, এই সময়
Post a Comment