Header Ads

বাংলার দামাল সৈনিক, নাম তাঁর বাঘাযতীন



১০ ই সেপ্টেম্বর ১৯১৫ সাল। বুড়িবালামের যুদ্ধের পর দাদা তখন গুলিবিদ্ধ।তাঁকে আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয় বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে। পরদিন দাদা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুর কিছুক্ষন আগে তখনও রক্তবমি হচ্ছে। হেসে বললেন- "এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।"

I have met the bravest Indian. I have the greatest regard for him but I had to do my duty . মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে এ কথাই বলেছিলেন কলকাতার তত্‍কালীন পুলিশ কমিশনার চার্লস টের্গাট।

তিনি বাঘাযতীন। বাংলা ও বাঙালির গর্ব।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা ব্রিটিশ বিরোধী দেশ জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন। বাঘাযতীন ওড়িশার বালেশ্বরে এসে 'ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়াম' গঠন করে আত্মগোপন করেন।এই প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসাবে ইউরোপের একজন প্রবাসী ভারতীয় জার্মান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভারতে বিপ্লব অভ্যুত্থানের জন্য জার্মানি থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্যের আশ্বাস পান। এই উদ্দেশ্যে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ভারতীয় বিপ্লবীদের জন্য বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সি.আর.মার্টিন নাম নিয়ে বাটাভিয়ার যান ও সেখানে জার্মান দূতাবাস মারফত জার্মানির সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরলেন যে জার্মান অস্ত্র বোঝাই তিনখানি জাহাজ ভারতে আসবে।প্রতিশ্রুতি মতো জার্মান কনসাল ম্যাভেরিক, অ্যানি লার্সেন ও হেনরি-এস নামে তিনটি অস্ত্রবোঝাই জাহাজ একটি হাতিয়ায়, একটি সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে এবং একটি ওড়িশার বালেশ্বর উপকূলের উদ্দেশ্যে পাঠান। কিন্তু ইংরেজ সরকার এই অস্ত্র আমদানির কথা জানতে পেরে 'মাভেরিক' সহ অস্ত্রবোঝাই তিনখানি জাহাজই আটক করেন।

কলকাতা থেকে খবর এলো, একের পর এক বিপ্লবীদের কেন্দ্রগুলিতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ 'ইউনিভার্সাল এম্পোরিয়ামে' তল্লাশি চালায়।বালেশ্বরের সন্ধান পেতে দেরী নেই।

দুর্গম ডুভিগর পর্বতশ্রেণী দিয়ে গা ঢাকা দেবার উপযোগিতা নিয়ে কেউ কেউ যখন জল্পনা-কল্পনা করছেন, যতীন দৃঢ়স্বরে জানালেন, "আর পালানো নয়।যুদ্ধ করে আমরা মরবো।তাতেই দেশ জাগবে।"

৭ ই সেপ্টেম্বর গভীর রাত্রে যতীন নিজের সাময়িক আস্তানা মহলডিহাতে ফিরে এলেন।সঙ্গে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ৮ সেপ্টেম্বর সারাদিন কেটে গেল গভীর জঙ্গলে। সারারাত পায়ে হেঁটে ৯ ই সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পৌঁছলেন বালেশ্বরের নদী বুড়ি বালামের উপকণ্ঠে।সাঁতার কেটে নদীর ওপারে গিয়ে যুদ্ধের পক্ষে মোটামুটি উপযুক্ত শুকনো এক ডোবার মধ্যে আশ্রয় নিলেন।বিপরীতপক্ষে চার্লস টেগার্ট, কমান্ডার রাদারফোর্ড, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলভি অসংখ্য সশস্ত্র পুলিস ও সামরিক বাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছিল।পরীখার আড়ালে বাঘা যতীনের নেতৃত্বে মোট পাঁচজন, হাতে মাউজার পিস্তল। বালেশ্বর থেকে ত্রিশ মাইল দূরে কাপ্তিপোদা নামক স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়।স্থানটি বুড়ীবালামের তীরে বলে এটি বুড়ীবালামের যুদ্ধ নামে খ্যাত। এই অসম যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথের পাশাপাশি তাঁর চার সঙ্গী জ্যোতিষ পাল, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন দাশগুপ্ত বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়েছিলেন।যুদ্ধ শুরু হলে পুলিসের গুলিতে ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। বিচারে জ্যোতিষ পালের ১৪ বছর (যাবজ্জীবন) সশ্রম কারাদন্ড হয় এবং আহত মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন দাশগুপ্তের ফাঁসি হয়।এই যুদ্ধের এমন নজির ইতঃপূর্বে দেখেননি বলে মেনে নিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ইংরেজ কুশীলবেরা।

বিপ্লবী অতুলকৃষ্ণ ঘোষ লিখেছেন, ‘শিবাজীর মতো রণকুশলী ও চৈতন্যের মতো হৃদয়বান একাধারে পেলে আমরা পাই যতীন্দ্রনাথকে।তাঁকে ভারতীয় বিপ্লবের গ্যারিবল্ডিবলেছিলেন যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়।

নরখাদক বাঘের অত্যাচার থেকে গ্রামবাসীদের বাঁচাতে ভোজালি দিয়ে বাঘ হত্যা করেছিলেন তিনি। সেই থেকেই তাঁর নামের আগে জুড়ে যায় বাঘা। এই তেজের সূত্রপাত কৈশোর থেকে। একটা পাগলা ঘোড়াকে কাবু করে এক শিশুকে বাঁচিয়েছিল কিশোর যতীন। কলকাতার রাস্তাতেও ইংরেজ সেনাদের উদ্ধত ব্যবহার সহ্য না করতে পেরে তাঁদের বেদম পিটিয়েছিলেন তিনি।

১৯০৭ সালে বিশেষ কর্ম-দায়িত্ব নিয়ে হুইলারের সচিবদের সঙ্গে যতীন সপরিবারে দার্জিলিংয়ে স্থানান্তরিত হলেন। সমস্ত উত্তর বাংলার মতো এখানেও যতীন "অনুশীলন"-এর সক্রিয় শাখা স্থাপন করেছিলেন। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে ক্যাপ্টেন মার্ফি ও লেফটেন্যান্ট সমারভিল প্রমুখ চারজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে যতীনের মারপিট হয় শিলিগুড়ি স্টেশনে।চারজনের চোয়াল ভেঙে ধরাশায়ী করে দেবার অপরাধে যতীনের নামে মামলা রুজ্জু হলে সারাদেশে বিপুল হর্ষ জাগে-কাগজে এই নিয়ে লেখালেখির বহর দেখে সরকার চাপ দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে।

ঠাট বজায় রাখতে ম্যাজিস্ট্রেট যতীনকে শাসিয়ে দেন, "এমনটি আর যেন না ঘটে!"

দর্পভরে যতীন জবাব দেন-"নিজের সম্মান বা দেশবাসীর সম্মান বাঁচাতে যদি প্রয়োজন হয়, এমনটি যে আবার করব না, এ শপথ আমি করতে অপারগ।"

হুইলার একদিন ঠাট্টা করে যতীনকে জিজ্ঞাসা করেন-"আচ্ছা, একা হাতে ক'টা লোককে আপনি শায়েস্তা করতে পারেন?"

হেসে যতীন বলেন, "ভাল মানুষ হয় যদি, একটাও নয়; দুর্বৃত্ত হলে যতগুলি খুশি সামলাতে পারব।"

ছোটবেলা থেকেই বাঘা যতীন অকুতোভয়।স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন।প্রতিদিন গীতা পাঠ করতেন। সে অভ্যেস তাঁর রয়ে গিয়েছিল আজীবন।মহুলডিহার শালবনে অজ্ঞাতবাসে থাকার সময়ও শিলাসনে বসে উদাত্ত গলায় গীতা পাঠ করতেন।সাক্ষী ছিলেন তাঁর সঙ্গী নলিনীকান্ত কর।এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সেই অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে আত্মহারা হয়ে যেতাম।মনে হত যেন গৌতম মুনি স্বয়ং বেদমন্ত্র উচ্চারণ করছেন।

বাঘা যতীনের জীবনের নানা ঘটনা জানা যায় যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বই বিপ্লবী জীবনের স্মৃতিথেকে। যেমন, এক বৃদ্ধার ঘাসের বোঝা তাঁর কাছ থেকে নিজে মাথায় করে নিয়ে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর একবার ওলাওঠা রোগীর মলমূত্র নিজের হাতে সাফ করে তার সেবা করেছিলেন। আর এক বার তো পুরো বেতন অন্য এক জনকে দিয়ে তারই কাছ থেকে পাঁচ পয়সা ধার করে ট্রামে করে বাড়ি ফিরেছেন। শ্রান্ত, যন্ত্রণাকাতর সহযোদ্ধাদের নিজে হাতে শুশ্রূষা করতেন যতীন।গরমের দিনে পাখার বাতাস করে ঘুম পাড়াতেন তাঁদের।যাদুগোপাল তাঁর বইয়ে লিখছেন, ‘শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে তিনি এত বলীয়ান ও উচ্চস্তরে বিচরণ করতেন যে, তাঁর সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন দ্বিতীয় ব্যক্তি চোখে ঠেকেনি।মানুষ হয়তো পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।কিন্তু পূর্ণতার কাছাকাছি যারা পৌঁছেছেন, তাঁদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথের স্থান সুনিশ্চিত।

১৯১৩ সালে বর্ধমান ও কাঁথির ভয়াবহ বন্যায় ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে।সেই সময়ের কথা জানা যায় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে, ‘যতীনদা বসেছেন উদার আকাশের নীচে দৌলতপুর কলেজ হোস্টেলের দোতলার খোলা বারান্দায়। গভীর রাত।আমি একলা ওঁর দিকে চেয়ে বসে। যতীনদার ওই মুখখানা, ওই চোখ দুটো, ওই বুকখানার সঙ্গে ওই আকাশখানার কোথায় যেন যোগ আছে, কোথায় যেন মিল আছে।এই মানুষটাই কিন্তু বিদেশি শক্তির সাহায্যে প্রথম দেশ স্বাধীন করার কথা ভেবেছিলেন।জার্মান জাহাজ ধরা পড়ার খবরে শান্ত ভাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বিদেশের সাহায্যে ভারতকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। দেশ কিন্তু নিজের জোরে দাঁড়াবে।অপরের সাহায্যে নয়।বালেশ্বরের অজ্ঞাতবাস থেকে দিদি বিনোদবালাকে চিঠিতে যতীন লিখেছিলেন, ‘সংসারে সমস্তই যে কত অস্থায়ী তাহা আপনি অনেক প্রকারে দেখিয়াছেন এবং বুঝিয়াছেন। এই অস্থায়ী সংসারে অস্থায়ী জীবন যে ধর্মার্থে বিসর্জন করিতে অবকাশ পায়, সে তো ভাগ্যবান।

১৯১৫ সালের ১০ ই সেপ্টেম্বর বুড়িবালামের তীরে মারা গেলেন বাঘাযতীন। তিনিই প্রথম ভারতীয় বিপ্লবী যিনি ট্রেঞ্চ খুঁড়ে যুদ্ধ করেছিলেন।তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে চিত্তরঞ্জন দাশ বলেছিলেন, ‘‘আমরা মশলা পিষতে শালগ্রাম শিলা ব্যবহার করেছি।’’ মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমার জীবনে একটি মাত্র মানুষকে একপ্রকার অন্ধের মতো অনুসরণ করতাম, সেই মানুষটির আদেশ আমি ভুলতে পারতাম না।তিনি আমাদের দাদা ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি আমাদের সর্বাধিনায়কও ছিলেন।

তাঁর জীবনের ঘটনা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। তিনি বাঙালি জাতির নায়ক। মহান দেশপ্রেমিক বাঘাযতীন। শতকোটি প্রণাম।


তথ্য-আনন্দবাজার এবং উইকিপিডিয়া



No comments