Header Ads

এমনই ছিলেন তিনি


নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা একমাত্র রোজগেরে। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মায়ের জটিল অসুখ। খুলনার বাড়িতে বেশিদিন থাকা হল না ছেলেটির। ভাইবোনদের সঙ্গে মা কে নিয়ে পাড়ি দিলেন মামাবাড়িতে ডায়মন্ডহারবারের নেত্রায়। মায়ের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য বিশেষ ছিল না। যে বাড়িতে লোকে খেতেই পায় না, সেই বাড়িতে সুচিকিৎসা করানো আকাশকুসুম স্বপ্ন। মায়ের যেটুকু চিকিৎসা হয়েছিলডাক্তার বদ্যি ধরতেই পারল না অসুখ। প্রায় বিনা চিকিৎসায় চলে গেল মা।

ছোট্ট ছেলেটি সেদিন ঠিক করেছিল এমন কিছু একটা তিনি করবেন যাতে গরীব মানুষের কাছে সুচিকিৎসা পৌঁছে যায়, বিনা চিকিৎসায় যেন কোনো গরীব মানুষের মৃত্যু না হয়। তিনি শপথ নিয়েছিলেন দারিদ্রকে হারানোর, দারিদ্র্য যাতে চারপাশের আর কারোর প্রান না নিতে পারে।



নেত্রায় যে মামাবাড়িতে জন্ম হয়েছিল ১৮৬১ সালের ১ লা অক্টোবরসেটাই হয়ে গেল মাথা গোঁজার ঠাঁই। কিন্তু বিপত্তি সেখানেও। নদীর প্লাবনে তাঁদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে চলে যায়। পরিবার স্থানান্তরিত হয় জয়নগরে। এই জয়নগরেই স্থানীয় বাংলা মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হয় ছেলেটি। এন্ট্রান্স পাশ সেখান থেকেই। এরপর মেট্রোপলিটান কলেজ থেকে এলএ ও বিএ পাস করেন। কিছুদিন চাতরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কার্যভার সামলালেন। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর অনুরাগ প্রবল। ১৮৮৫ সালে ভর্তি হন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজে। এক ব্রিটিশ সাহেব টের পেয়েছিলেন ছাই চাপা আগুনের আঁচ। বহন করেছিলেন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজে তাঁর পড়ার সব খরচ। ১৮৮৮ সালে এম বি ডিগ্রি১৮৯০ সালে এম ডি।

১৮৮৮ সালেই বিবাহ। ব্রাহ্মনেতা গিরীশচন্দ্র মজুমদারের মেয়ে নির্মলাকে। নিজেও গ্রহণ করেন ব্রাহ্ম ধর্ম। দুজনের পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র।

মেডিক্যাল কলেজে থেকে এমবি হয়ে তিনি মেয়ো নেটিভ হাসপাতালে হাউস সার্জেনের পদে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যেই চিকিৎসক হিসাবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর পারিশ্রমিক দুই টাকায় আরম্ভ হয়ে ধীরে ধীরে ৬৪ টাকা অবধি হল। তৎকালীন সময়ে যা কল্পনাতীত। দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা করতেন বিনা পয়সায়। বিনামূল্যে দিতেন ওষুধ ও খাবার। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং তারপর ফ্যাকাল্টি অফ সায়েন্স ও ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিনের ডিন হন।

বাংলাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে রাধাগোবিন্দ কর এবং সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারীর সঙ্গে একযোগে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরে কারমাইকেল কলেজ এবং বর্তমানে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ নামে খ্যাত হয়। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন্য ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয়। ১৯২০ সালে তাঁর ইমপিরিয়াল ইউনিভার্সিটি কমিশনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। এসময়েই তিনি লন্ডন যাত্রা করেন। তাঁর যোগ্যতার পরিচয় পেয়ে অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিসি এল এবং ডি এল উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। দেশে ফিরে তিনি দেশহিতকর কাজে মনোনিবেশ করেন। যাদবপুর যক্ষা হাসপাতাল যা পরে কুমুদশঙ্কর রায়ের নামে নামান্বিত হয়, তাঁরই উদ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সম্পাদক হিসাবে তিনি কারিগরি বিদ্যাপ্রসারে সচেষ্ট হন। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালকাটা মেডিক্যাল ক্লাব।

তাঁর মূল গবেষণার বিষয় ছিল সিরোসিস অব লিভার ইন চিলড্রেন্স। এর জন্য তাঁকে মাতৃদুগ্ধ, গোদুগ্ধ এবং ছাগদুগ্ধের তুলনামূলক উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে গবেষণা করতে হয়। আবহাওয়ার তারতম্য বোঝানোর জন্য রোগীকে দার্জিলিঙের পাহাড়েও নিয়ে গিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে এই রোগের প্রকোপ কমে গেলেও এই রোগের কারণে শিশুমৃত্যুর হার খুবই বেশি ছিল। তিনি উপযুক্ত খাদ্য এবং ওষুধের সাহায্যে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান করেন। গবেষণাপত্রটি প্রথম ভারতীয় মেডিক্যাল কংগ্রেসের ট্রান্সাকশনে প্রকাশিত হয়।

স্বদেশী শিল্প ছাড়া কোনও জাতি উন্নতি করতে পারে না এটা তিনি বুঝেছিলেন। তাই স্বদেশী শিল্প স্থাপনে দারুণ উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ছিল ন্যাশনাল ট্যানারি। এছাড়া তিনি ন্যাশনাল সোপ কারখানার প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। রাঙামাটি চা কোম্পানী যা পরে ইস্টার্ন টি কোম্পানি নামে পরিচিত হয়। তাও তাঁর অর্থ বিনিয়োগে গঠিত হয়। ১৯০৮ সালে তিনি লুট অ্যান্ড ইমপ্রুভমেণ্ট কোম্পানীর ডিরেক্টর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ ছিলেন।

বাংলার ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে তোলার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বসুবিজ্ঞান মন্দির, বিশ্বভারতী এবং ভারতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

রাজনীতিতেও তাঁর অবদান কম নয়। ১৮৯০ সালে তিনি জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং ১৯১৯ পর্যন্ত যুক্ত থাকেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমতিলাল নেহরুমহাত্মা গান্ধীদেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসনেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসজগদীশচন্দ্র বোসের মতো ব্যক্তিত্বের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯১২-২৭ পর্যন্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সংস্থার সদস্য ছিলেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। তাঁর বেশিরভাগটাই তিনি জনহিতকর কাজে ব্যয় করেন।

সমস্ত রোগের মূল সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিল-
"At the root of all evils lies our terrible ignorance- ignorance of the origins nature symptoms and course of this disease. Ignorance of the method of treatment of this disease, ignorance of the measures to be adopted to check it spread."


তাঁর ৬১ নম্বর রোডের বাড়িতেই ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি তৈরি করেন। সেখানে সবরকমের রক্ত, মল, মূত্র, কফ এবং অন্যান্য দেহ-তরলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতো। বিদেশ থেকে কার্ডিওগ্রাফ মেশিন আনান। সেইসঙ্গে একাধিক অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও আমদানি করেন। এইভাবে অত্যন্ত আধুনিক পদ্ধতিতে তিনি চিকিৎসা করতেন।

তিনি ছিলেন একজন উঁচুমানের গবেষক আর শিক্ষক। ১৮৯৪ সালের ২৭শে নভেম্বর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এ জীববিদ্যা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলে তিনি একটানা দুবছর বায়োকেমিষ্ট্রি বিষয়ে ক্লাস নিয়ে যান।

নীলরতন সরকার বাংলা ও বাঙালির গর্ব। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন নীলরতন সরকারের দাদা। দেশের স্বাধীনতা অবশ্য দেখে যেতে পারেননি। ১৯৪৩ সালের ১৮ ই মে প্রয়াত হন ৮১ বছর বয়সে। তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের নতুন নামকরণ হয় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। বাংলার ইতিহাসে এমন মানুষ যথেষ্ট দুর্লভ। 



তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া , Jessore ইনফো ব্লগ


No comments