Header Ads

খালি পায়ে বিপ্লব || প্রথম পর্ব || মোহনবাগান ক্লাবের জন্ম ও উত্থান


মোহনবাগান নিজেই একটি ইতিহাস। সবুজ-মেরুন জার্সি মানেই প্রবল প্রতিজ্ঞায় এগিয়ে যাবার উদ্যম। মোহনবাগান তাই একটি দল নয়, একটি আবেগ।



আজও ফুটবলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল লড়াই মানেই যেন ঘটি-বাঙালের চিরায়ত দ্বৈরথ, যার আঁচে আন্দোলিত হয় গোটা পশ্চিমবঙ্গ। সেই মোহনবাগান ক্লাবটি কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সেলোনার থেকেও বয়সে বড়। বাম তাত্ত্বিক বা দুঁদে নেতাদের ভাষ্যে চটুল সংস্কৃতি, খেলা, ধর্ম ইত্যাদির দ্বারা মানুষকে সহজেই ভুলিয়ে রাখা যায়, তখন তারা ভুলে যায় তাদের অধিকারের কথা, শোষণের প্রতিবাদে গর্জে ওঠার কথা। সম্ভবত সে সূত্র অনুসরণ করেই ভারতের জনগণের রাজনৈতিক অসন্তোষের বিপরীতে তাদের মজে থাকবার জন্য আফিমহিসেবে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে ফুটবল। ওদিকে খেলাকে যতই অরাজনৈতিকবলা হোক, রাজনীতি আর খেলাকে কখনোই সম্পূর্ণ আলাদা রাখা যায়নি। শোষকের অস্ত্রকে তাই শোষকের বিরুদ্ধেই ঢাল করবার সিদ্ধান্ত নিলো বাঙালিরা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহের নানা সৃষ্টিশীল অনুপ্রেরণা তৈরির অংশ হিসেবে ফুটবল খেলাটাকে সেই থেকে নিজের করলো বাঙালি। এরই সূত্র থেকে উত্তর কলকাতার ফড়িয়াপুকুরে তিন অভিজাত মিত্র, সেন ও বসু পরিবার ১৮৮৯ সালের ১৫ আগস্ট এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন। পরিবারের কিরটী মিত্রের বাড়ি মোহনবাগান ভিলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ক্লাবটির নাম রাখা হয় মোহনবাগান স্পোর্টস ক্লাব’, পরবর্তীতে যার নাম হয় মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব। ক্লাবের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন বসু পরিবারের নামী আইনজীবী ভূপেন্দ্রনাথ বসু।

কথিত আছে, মোহনবাগান ভিলায় ইডেন হিন্দু হোস্টেলের বিরুদ্ধে এই দল প্রথম খেলেছিল। প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঠিক আগে অধ্যাপক এফ. জে. রো জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, এই দল কোনো রাইফেল শ্যুটিং বা আংলিং বা এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত কিনা। মোহনবাগান এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত নয় জেনে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের নাম পালটে মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবরাখতে। ক্লাবের কর্মকর্তারা এই পরামর্শ মেনে নিয়ে ক্লাবের নাম পরিবর্তন করেন। ১৮৯১ সালে কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে এই দল চলে আসে। পরে এই দল উঠে যায় শ্যাম স্কোয়ার অঞ্চলে। ১৮৯৩ সালে মোহনবাগান কোচবিহার কাপে অংশগ্রহণ করে। এটিই ছিল ক্লাবের প্রথম টুর্নামেন্ট।

পরবর্তীকালে মোহনবাগান কোচবিহার কাপ ও ট্রেডস কাপ সহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু জয়লাভে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে কলকাতা পৌরসংস্থা শ্যাম স্কোয়ার নামে একটি সরকারি স্কোয়ার উদ্বোধন করলে, এরিয়ানস ও বাগবাজার ক্লাবের সঙ্গে মোহনবাগান এই স্কোয়ারে জায়গা পায়। ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত শ্যাম স্কোয়ার ছিল মোহনবাগানের তৃতীয় মাঠ।

১৯০৪ সালে কোচবিহার কাপে অংশ নিয়ে মোহনবাগান প্রথম ট্রফি জেতে। ১৯০৫ সালে তারা আবার এই ট্রফি জিতেছিল। এই বছরই চুঁচুড়ায় আয়োজিত গ্ল্যাডস্টোন কাপে তৎকালীন আইএফএ শিল্ড জয়ী ডালহৌসিকে মোহনবাগান ৬-১ গোলে পরাজিত করে। ১৯০৬ সালে মোহনবাগান ট্রেডস কাপ, গ্ল্যাডস্টোন কাপ ও কোচবিহার কাপ এক সঙ্গে জয় করে। ১৯০৭ সালে মোহনবাগান আবার ট্রেডস কাপ জেতে। ১৯০৮ সালেও এই কাপ জিতে পরপর তিন বছর এই কাপ জয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করে মোহনবাগান। এরপরেই সুযোগ আসে প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে আই এফ এ শিল্ডে খেলার | আর বাকিটা ইতিহাস | ১৯১১ সালে মোহনবাগান ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে পরাজিত করে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আই এফ এ শিল্ড জয় করে।



মোহনবাগান নামটির উৎপত্তি নিয়ে নানা মুনির নানা মত l মোহনবাগান ক্লাবের জন্ম হয়েছিলো ১৮৮৯ সালের ১৫ ই আগস্ট , উত্তর কলকাতার মোহনভিলার মাঠে l তবে ক্লাবের প্রথম সভাটি হয় ১৪ নং বলরাম ঘোষ স্ট্রিটে ভূপেন্দ্র নাথ বসুর বাড়িতে l এই মোহন ভিলা এবং তার ভিতরের মাঠটির সীমানা ছিলো উত্তরে ফড়িয়াপুকুর স্ট্রিট,পূর্বে আপার সার্কুলার রোড,পশ্চিমে কীর্তি মিত্র লেন এবং দক্ষিনে মোহনবাগান লেন, ভিলাটি আসলে প্রাসাদের মালিক ছিলেন কীর্তি মিত্র এই বৃত্তান্ত একসময় প্রামান্য তথ্য বলে ধরা হতো l পরবর্তীকালে অনুসন্ধান করে আরো কিছু অন্যরকম তথ্য জানা যায় I ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত কোলকাতা কর্পোরেশনের মানচিত্রে দেখা যায় মোহনবাগান রো নামে তখন একটি রাস্তা ছিল।

মোহনবাগানের আদি পর্ব সম্পর্কে একটা ধারনা আছে, জন্মের দু বছর বাদে মোহনবাগান চলে যায় শ্যামপুকুরে দুর্গাচরন লাহাদের মাঠে, সেই আদি পাড়ায় মোহনবাগানের নাম স্থায়ী করা হয় দুটি রাস্তার নামকরণ করে l এই ধারনাটি ঠিক নয় l কেননা মোহনবাগান ক্লাবের জন্মের দু বছর আগেও মোহনবাগান লেন এবং মোহনবাগান রো নামে দুটো রাস্তা ছিল।

তাহলে মোহনবাগান নামটা এলো কোথা থেকে ? পুরনো নথিপত্রে অবশ্য নানারকম উল্লেখ আছে l মোহনবাগান নামটি এসেছে রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের পিতা রাজা গোপীমোহন দেবের নাম অনুসারে। (শর্ট হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা,অতুলকৃষ্ণ রায়,সেন্সাস অ্যাসিসটেন্ট অফিসার ১৯০১, পৃষ্ঠা ৯২)



আবার কেউ কেউ বলেছেন , বিশিষ্ট জমিদারবাবু মোহনলাল মিত্রর নাম থেকেই মোহনবাগান নামটির উৎপত্তি। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট (বর্তমানে বিধান সরণি) ও সার্কুলার রোডের সংযোগস্থলে বিশাল প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকতেন এই মোহনলাল (শরতচন্দ্র মিত্র,ন্যাশনাল ম্যাগাজিন ১৮৮৯ডিসেম্বর) মোহনবাগান নামটির সঠিক কোথা থেকে এসেছে এই ব্যাপারে ফুটবল গবেষকরাও কিন্তু সঠিক ভাবে আলোকপাত করতে পারেননি কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত যে মোহনবাগান মাঠ ছিল মোহনবাগান লেনের দক্ষিন দিকের খালি অংশটিতে l মোহনবাগান ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হবার পর সদস্যপদের ফি ছিল ১টাকা, মাসিক চাঁদা ২৫ পয়সা। পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কোচবিহারের মহারাজা রাজেন্দ্রনারায়ন ভূপ l (ক্যালকাটা ডাইরেক্টরি ১৯১২)।



তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া , দেবু দত্তের ব্লগ


No comments