Header Ads

আজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম হুল বিদ্রোহের ১৬৪ বছর

আজ ৩০ শে জুন, ঐতিহাসিক সান্তাল হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৪ বছর। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক আর সুদখোর, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় বিভিন্ন সময়ে রুখে দাঁড়ালেও প্রথম সংগঠিত বিদ্রোহটি শুরু হয়েছিল চার সাহসী সাঁওতাল যুবক সিধু আর কানহু মুর্মু, চান্দ ও ভাইরোর নেতৃত্বে ১৮৫৫ সালের ৩০ শে জুন। অংশ নিয়েছিলেন আদিবাসী সমাজের কৃষক ,কুমার, তেলী, কর্মকার, চামার, ডোম, মোমিন সম্প্রদায়ের গরিব মুসলমান ও গরির হিন্দু জনসাধারণ। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।



সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালের ৩০ শে জুন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। এটি ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। আর এই বিদ্রোহকে দমন করতে এদেশে প্রথম জারি করা হয়েছিল সামরিক আইন (১৮০৪,১০নং রেগুলেশন ৩ধারা) ৷ সাওতাঁলরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলেও ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিল বন্দুক ও কামান। তারা ঘোড়া ও হাতি যুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। রিজলি হান্টারদের মতে ঐ বিদ্রোহের এক বছর সময়কালে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার বিদ্রোহী ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিল ৷ বেসরকারী মতে আরো বেশী। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা ব্রিটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে সিধু-কানহু-চান্দ ও ভাইরব পর্যায়ক্রমে নিহত হলে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় ও বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।

সান্তাল হুলের ইতিহাস হতে জানা যায় দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ। বহু কষ্ট করে জঙ্গল কেটে বন সাফ করে তারা তাদের জনপদ গড়ে তুলেছিল। অতীতে যে মাটিতে কোন মানুষের পা পড়েনি, সে মাটিকে তারা বাসযোগ্য করে গড়ে তুলেছিল আর সে মাটিতে ফলিয়েছিল ধান, ভুট্টা, নানা ধরণের সব্জি আর সোনালী ফসল। সুখে ছিল তারা দামিন-ই কোহতে। সে জগতে কোন মহাজন, দালাল, জমিদার ছিলনা। কেউ ঋণী ছিল না তখন। কিন্তু ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণী দলে দলে আসতে শুরু করল সাঁওতাল পরগনায়। মহাজন ও ব্যবসায়ী শ্রেণী সাঁওতাল পরগনায় ঢুকে বিপুল পরিমাণ ধান, সরিষা ও অন্যান্য তৈলবীজ গরুর গাড়ী বোঝাই করে নিয়ে যেত। বিনিময়ে সাঁওতালদের দেওয়া হতো সামান্য লবণ, টাকা-পয়সা, তামাক অথবা কাপড়। এখানে বিনিময়ের সময় চরমভাবে ঠকানো হতো সাঁওতালদের। মহাজন, দালাল, জমিদার কর্ত্তৃক নিরীহ ও সরল আদিবাসীদের শোষণ ও নির্যাতনে পরোক্ষ মদত দিতো ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনী। এ কারণে আদিবাসীরা এক জোট হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।



১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জুন প্রায় ত্রিশ হাজার সাঁওতাল কৃষকের বীরভূমের ভগনাডিহি থেকে সমতলভূমির উপর দিয়ে কলিকাতাভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে। এটি ছিল ভারতের ইতিহাসে এটাই গণ পদযাত্রা। ব্রিটিশ শাসনে সেটাই ছিল ব্রিটিশ বিরোধী সর্ববৃহৎ জনসমাবেশ৷ আওয়াজ উঠেছিল হুল হু- - ল হু- - -ল ৷ অর্থাৎ বিদ্রোহ৷ সাঁওতাল বিদ্রোহ৷

৭ ই জুলাই দিঘি থানার মহেশলাল দারোগাসহ ১৯ জনকে হত্যার মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। বিদ্রোহকে নির্মুল করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বড় কর্তারা ৩৭শ, ৭ম, ৩১শ রেজিমেণ্ট, হিল রেঞ্জার্স, ৪৩, ৪২ ও ১৩ রেজিমেন্ট প্রভৃতিকে ব্যবহার করেছিলো।

সাঁওতাল নেতাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সেদিন কমিশনার প্রধান নায়কের জন্য দশ হাজার টাকা, সহকারী নায়কের প্রত্যেকের জন্য পাঁচ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় নায়কদের জন্য এক হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেছিলেন। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ১০ নং রেগুলেশনের ৩ ধারা অনুযায়ী ১০ই নভেম্বর, সামরিক আইন জারি করা হয়। সিধু-কানুকে ষড়যন্ত্র করে ধরিয়ে দেওয়া এবং হত্যার পরই স্তমিত হয়ে পড়ে বিদ্রোহ। এই ইতিহাসখ্যাত আন্দোলনে আদিবাসী সাঁওতাল নারীদের অংশগ্রহণ ছিলো অত্যন্ত স্বতস্ফুর্তভাবে। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আদিবাসী নারীরা ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকেনি, তারাও হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। সিধু-কানুর বোন ফুলমনির লাশ উদ্ধার করা হয় রেললাইনের ধার থেকে। শোনা যায়, ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের পর ব্রিটিশ সেপাইরা তাকে হত্যা করে সেখানে ফেলে যায়।



সাঁওতাল জাতির ইতিহাসে সিধু-কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল যুদ্ধই ছিলো সর্বাধিক বৃহত্তম এবং গৌরবের বিষয়। তাদের এই বিদ্রোহই ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ বপন করে গিয়েছিল। এই সংগ্রামের ফলে ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করলেন। ম্যাজিস্ট্রেট এডন সাহেব সাঁওতালদের আবেদন শুনলেন। যুদ্ধের পরে সাঁওতালদের সমস্যা বিবেচনা করে আদিবাসী সাঁওতালদের জন্য একটি জেলা বরাদ্দ করা হলো। এই জেলার নাম হলো ডুমকা। এটাই সাঁওতাল পরগনা নামে পরিচিত। এখানে সাঁওতাল মানঝি্, পরানিক, পরগনা জেলার শাসন পরিচালনার জন্য দারোগা, পুলিশ ও বিভিন্ন সরকারি কমকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতা প্রাপ্ত হল। সাঁওতালদের বিচার সালিশ তাদের আইনে করার জন্য সরকার ক্ষমতা প্রদান করলেন। খাজনা, কর প্রভৃতি তাদের হাতে অর্পণ করা হলো। তারা জেলা প্রশাসক বা ডিসির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকলো। ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল টেনান্সি এ্যাক্ট অনুযায়ী আদিবাসীরা তাদের জমি সরকারী অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারতো না। এই আইন এখন পর্যন্ত কার্যকর আছে।



সাঁওতাল বিদ্রোহ পরাধীন ভারতবর্ষকে প্রথম স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তাই এই দিনটিকে স্বাধীন ভারতের নাগরিকরা যুগ যুগ ধরে স্মরণ করে আসছে হুল উৎসবের মাধ্যমে।

"নেরা নিয়া নুরু নিয়া,
ডিদা নিয়া বিটা নিয়া,
মাপাক গপচ দো, 
নুরিচ নাড়াড় গাই কাডা, 
নাচেল লাগিৎ,
পাচের লাগিৎ,
সেকায় লেকা বেতাবেতেৎ ঞাম রুওয়াড লাগিৎ,
তবে দা বোন হুল গেয়া হো।"


"আমরা আবার বিদ্রোহ করবো, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার জন্য, ভূমির অধিকারের জন্য, ফসলের জন্য, পূর্বের মত সব ফিরে পাবার জন্য, আমরা আবার বিদ্রোহ করবো। "


তথ্যসূত্র - উইকিপিডিয়া , উনিশ কুড়ি

No comments