Header Ads

ডাবের শরবত আর ইতিহাস


১৯১৮ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, বরিশাল অনুশীলন সমিতির সদস্য বরিশালের কাঁচাবেড়িয়া গ্রামের বঙ্গসন্তান নীহাররঞ্জন মজুমদার কলকাতায় পাড়ি দেন। উদ্দেশ্য একটাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ। খাদ্যরসিক নীহাররঞ্জনবাবুর কাছে শরবতের অর্থ ছিল আতিথেয়তা। নিজের শখকে পূরণ করতেই কলকাতায় এসে কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে খুলে ফেললেন এক সরবতের দোকান। নাম প্যারাডাইস। কিন্তু শরবত বিক্রি তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না। শরবতকে সামনে রেখে দোকানের পিছনে চলত স্বদেশী কাজ কর্ম। কে না আসতেন এখানে! বিপ্লবী সতীন সেন, বাঘাযতীন থেকে শুরু করে এখানে এসেছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুও। এক গ্লাস শরবতের আড়ালে গুপ্ত সমিতির কাজ। কিন্তু ব্রিটিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এই গোপন অনুশীলন কেন্দ্র একদিন ধরা পড়ে গেল। পুলিশ এসে বন্ধ করে দিল শরবতের দোকান। অনেকগুলো বছর বন্ধ হয়ে পড়ে থাকার পর ১৯৩৭ এ ফের খুলল দোকান। এবার প্যারাডাইস এর নাম বদলে রাখা হল প্যারামাউন্ট। সেই থেকে আজও হুবহু এক থেকে গেছে টেবিল-চেয়ার-সহ দোকানের পরিবেশ আর শরবতের রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ।



সেই থেকে শুরু। এই একশো বছর ধরে শুধু আট থেকে আশি প্রায় সকলকেই শরবতে মজিয়ে রাখা নয়,একশো বছর ধরে বাংলার এক অজানা ইতিহাস-ঐতিহ্য কে বাঁচিয়ে রাখার নাম প্যারামাউন্ট। কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস, পিৎজা হাটের যুগেও যার চাহিদা বিন্দুমাত্র কমেনি।

ডাবের শরবত, যা এই দোকানের বিশেষ শরবতগুলির মধ্যে অন্যতম। সেই শরবতের রেসিপি যাঁর দেওয়া তাঁর নাম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়! বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন নীহারবাবুর অত্যন্ত কাছের মানুষ। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নীহাররঞ্জন মজুমদারকে বলেছিলেন কীভাবে ডাবের শাঁস মিশিয়ে শরবতে আনতে হবে নতুন স্বাদ। সেই ভারতীয় বিজ্ঞানীর রেসিপিতেই ডাবের জল, শাঁস এবং সিরাপ দিয়ে তৈরি সেই ডাবের শরবত একশো বছর ধরে নট আউট।

এছাড়াও এখানকার উল্লেখযোগ্য শরবত হচ্ছে কোকো মালাই, ম্যাঙ্গো ম্যানিয়া, পাইনঅ্যাপেল মালাই, ডাব শরবত, ক্রিমরোজ, লিচুর শরবত, খাস সিরাপ, লেমন সিরাপ, গ্রিন ম্যাঙ্গো, আঙুর শরবত ইত্যাদি। শরবতের কত বৈচিত্র্য হতে পারে তা প্যারামাউন্টে না এলে জানা সম্ভব নয়।

সেই টানেই প্যারামাউন্টে বারবার ছুটে এসেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, মেঘনাথ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায়, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, সুচিত্রা সেন,মহানায়ক উত্তম কুমার, মনোহর আইচ, শঙ্খ ঘোষ। কে নেই সেই তালিকায়। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় প্রায়ই আসতেন প্যারামাউন্টের শরবত খেতে। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে এই প্যারামাউন্ট থেকে অর্ডার দিয়ে আনিয়েছিলেন তাঁর অলটাইম ফেভারিট ম্যাঙ্গো শরবত

নীহাররঞ্জনবাবুর মৃত্যুর বহু বছর পরেও মজুমদার পরিবারের সকলে মিলেই এই শরবত প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছেন | তাই এই দহন দিনে শুধু গলা ভেজাতে নয়,ইতিহাস কে একবার ছুয়ে দেখতেও যেতে পারেন প্যারামাউন্টে।




No comments