Header Ads

বরাক উপত্যকার ভাষাশহীদ পরিচিতি



সালটা ১৯৬১- আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চলছে। ১৯ শে মে আসাম সরকারের জাতিবাদী পুলিস গুলি চালায় বাংলা ভাষা আন্দোলনে। শহীদ হন ১১ জন বীর বাঙালি। সেদিন ১২ জন আন্দোলনকারীর দেহে গুলি লেগেছিল। ১২ জনের মধ্যে ৯ জন ঘটনার দিন এবং পরবর্তী সময়ে আরও দুজন তরুণ তাজা প্রাণ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ঘটনার দিন যে ৯ জন শহীদ হন তাঁরা হলেন : কানাই লাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। ঘটনার দুদিন পর অর্থাৎ ২১ মে যে দুজন শহীদ হন তাঁরা হলেন : বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্রকুমার দেব। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আরও ২৪ বছর বেঁচে ছিলেন কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস।

১. কমলা ভট্টাচার্য :

সেদিনের সেই শহীদদের মধ্যে ছিলেন ১৬ বছরের এক কিশোরী। নাম কমলা ভট্টাচার্য। বিশ্বের একমাত্র নারী চরিত্র, যিনি মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবিতে শহীদ হয়েছিলেন। তিনি সবেমাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন, পাশ করলেও সে রেজাল্ট তিনি দেখে যেতে পারেননি। তাঁর ডান চোখের পাশ দিয়ে একটা গুলি মাথায় ঢুকে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

কমলার জন্ম ১৯৪৫ সালে, অসমের শ্রীহট্টে। রামরমণ ভট্টাচার্য ও সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের পঞ্চম সন্তান হলেন কমলা। কমলারা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন। চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবেই তার পিতৃবিয়োগ হয়। পিতৃবিযোগের পর আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন কাটতে থাকে কমলার পরিবারের। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে অসমের শ্রীহট্ট জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কমলারা পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সার্বিক গণহত্যা আরম্ভ হলে তার রেশ শ্রীহট্টেও এসে পড়ে। কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে অসমে চলে আসতে বাধ্য হন। তারা শ্রীহট্টের পার্শ্ববর্তী অসমের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নেন। ( তাঁর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা রয়েছে আমাদের নিউজ পোর্টালের বাঙালি মহাপুরুষ বিভাগে)

২. শচীন্দ্রমোহন পাল :

মাত্র উনিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বুক পেতে নিয়েছিলেন আসাম সরকারের বুলেট শচীন্দ্র পাল। তাঁদের পূর্বনিবাস ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার নবিগঞ্জের সন্দনপুর গ্রামে। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে শচীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। কাছাড় হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন।

৩. কানাইলাল নিয়োগী :

আদিনিবাস ময়মনসিংহ জেলার খিলদা গ্রামে। মেট্রিক পাশ করে ১৯৪০ সালে রেলে চাকরি নেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শহীদ হন। তখন তাঁর মা শান্তিকণা নিয়োগীর বয়স ৭০ বছর। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী আগেই প্রয়াত।

৪. কুমুদ দাস :

পিতা কৃষ্ণমোহন দাস মৌলভিবাজারের জুরি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কাছাড়ে যান। মায়ের মৃত্যুর পর আট বছর বয়সে কুমুদ দাস ত্রিপুরায় মামার বাড়িতে থেকে এম.ই. পর্যন্ত পড়ে গাড়িচালকের পেশা গ্রহণ করেন। পরে শিলচরের তারাপুরে চা-দোকানে বয়ের কাজ নেন। বৃদ্ধ পিতা, চার বোন ও এক শিশু ভাইকে নিয়ে সংসার ছিল তাঁদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন কুমুদ দাস।

৫. তরণী দেবনাথ :

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের সময় শিলচরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন পিতা যোগেন্দ্র দেবনাথ। মৃত্যুকালে বয়ন ব্যবসায়ী তরণীর বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর।

৬. হীতেশ বিশ্বাস :

বাস্তুহারা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পিতৃহীন হীতেশ বিশ্বাস মাত্র বার বছর বয়সে ত্রিপুরার খোয়াই শহরের উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দা হন। মা, ছোট ভাই ও এক বোনের সংসার ছিল তাদের। শিলচর শহরে ভগ্নিপতির বাসায় অবস্থানকালে মাতৃভাষার জন্য জীবনদান করেন।

৭. চণ্ডীচরণ সূত্রধর :

পিতৃহীন চণ্ডীচরণ সূত্রধর ১৯৫০ সালে হবিগঞ্জের জাকেরপুর গ্রাম থেকে মামার সঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেন শিলচরে। পড়াশোনা এম.ই. পর্যন্ত। জীবিকা হিসেবে পৈতৃক বৃত্তি কাঠমিস্ত্রির কাজেই নিয়োজিত করেন নিজেকে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভাষার জন্য আত্মদান করেন। তিনি তখন একা শিলচরের রাঙ্গির খাড়িতে বাস করতেন।

৮. সুনীল সরকার :

ঢাকার মুন্সিবাজারের কামারপাড়া থেকে ভারত বিভাজনের বলি হয়ে শিলচর শহরের নূতন পট্টিতে গিয়ে ঘর বাঁধেন সুনীল সরকার। পিতা সুরেন্দ্র সরকার। ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রের তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে সুনীল ছিলেন সবার ছোট। মাত্র এম.ই.পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন সুনীল।

৯. সুকোমল পুরকায়স্থ :
করিমগঞ্জের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিতা সঞ্জীবচন্দ্র পুরকায়স্থ ডিব্রুগড়ে ব্যবসা করতেন। অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে বঙ্গাল খেদাঅভিযানের শিকার হয়ে সপরিবারে স্বগ্রামে চলে আসেন। ভাষা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়ে মাতৃভাষার ঋণ শোধ করেন সুকোমল।

১০. বীরেন্দ্র সূত্রধর :

শৈশবে বাস্তুহারা হয়ে পিতামাতার সঙ্গে নবিগঞ্জের বহরমপুর গ্রাম থেকে শিলচর যান। জীবিকার অন্বেষণে বর্তমান মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে গিয়ে কাঠমিস্ত্রির পেশা অবলম্বন করেন। বিয়ে করেন ত্রিপুরার ধর্মনগরে। পরে কাছাড় জেলায় অবস্থিত মণিপুর চা বাগানের কাছে ঘর ভাড়া নেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রী ও এক বছর বয়সী কন্যা রেখে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে আত্মদান করেন তিনি। শিলচর রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে ২০ শে মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

১১. সত্যেন্দ্রকুমার দেব :

মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করেন। উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় নূতন রাজনগর কলোনিতে তিন বোন ও মাকে নিয়ে আশ্রয় নেন পিতৃহীন সত্যেন্দ্র। মা ও বোনকে সেখানে রেখে জীবিকার অন্বেষণে শিলচরে গিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পড়াশোনা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় ২০ শে মে শিলচর রেল স্টেশনের পুকুর থেকে।

ঐতিহাসিক ১৯ শে মে'র কথা প্রচার করতে হবে। এটা বাঙালির গৌরবের ইতিহাস। বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিতে পারে। বাংলা ভাষা বড় প্রিয় আমাদের। বাংলা ভাষা বাঁচাতে ও বাঙালির অধিকার আদায় করতে ১৯ শে মে বারবার স্মরণ করতে হবে।
জয় বাংলা।

তথ্যসূত্র- মুক্তাঙ্গন



No comments