পটুয়াদের নিত্যনতুন ভাবনার আঙিনায় সুদিন ফিরছে বাংলার পটশিল্পের
পটের উপর আঁকা নানা পৌরাণিক
গল্প, আর গানের (পটের
গান) মাধ্যমে তা সুন্দর করে উপস্থাপন - পটশিল্প বাংলার নিজস্ব লোকশিল্প। গুহার
দেওয়ালে, পাথরে ছবি আঁকারই
একটা প্রকার এই পটশিল্প। 
আনুমাণিক ত্রয়োদশ শতকে
পটশিল্পের পথ চলা শুরু। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে পটচিত্র দেখিয়ে ও পটের গান শুনিয়ে
জীবিকানির্বাহ করতেন কিছু পটুয়া। "মনসামঙ্গল", "চন্ডীমঙ্গল", "কালিয়াদমন", "রামায়ণ","মহাভারত" এর
মত নানান পৌরাণিক কাহিনী ছিলো মূল বিষয়বস্তু। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে বিনোদন
ও শিক্ষার মাধ্যম ছিলো পটশিল্প। রঙ হিসাবে নানা ভেষজ জিনিসের ব্যবহার ও পশুর লোম
কাঠের টুকরোয় বেঁধে তুলি হিসাবে ব্যবহার করা হতো। পট মূলত দুই প্রকার- রোল করে
গোছানো "জড়ানো পট" ও "চৌকো পট"। ধাপে ধাপে জড়ানো পট খুলতে
খুলতে নিজদের লেখা, নিজেদের সুরে
পটের গান শোনান পটুয়ারা। একটা পট আঁকতে প্রায় মাস খানেক সময় লাগে।
|  | 
| ছবিটি medinipur.in ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে | 
সময় বদলায়, সহজলভ্য হয়
বিনোদন। বিংশ শতকের শুরুর দিক থেকে আস্তে আস্তে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে শুরু করে
পটশিল্প। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগ পটুয়া কাজ হারিয়ে অর্থকষ্টে ভুগতে
থাকেন। ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দের দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উৎসাহিত করেন পটুয়াদের।
পটশিল্পের মরা গাঙে কিছুটা জোয়ার আসে। পটুয়াদের মধ্যেও পরিবর্তন দেখা দেয়। আগে
সাধারণত পুরুষেরা পটুয়া হতেন, কিন্তু বাড়ির মহিলারা দায়িত্ব নেন। তারা এগিয়ে আসেন।
পটশিল্প কে মনোগ্রাহী করতে পৌরাণিক কাহিনীর সাথে সাথে সমসাময়িক নানা বিষয় তারা
পটচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরতে শুরু করেন। নতুন আঙ্গিকে পথ চলা শুরু করে পটচিত্র।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা, সুনামী ও নানা ঐতিহাসিক ঘটনাও বিষয়বস্তু হয়ে যায়। নতুন
প্রজন্ম খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনে নতুন নতুন বিষয় পড়ে পট সৃষ্টি করছেন। চৌকোপটের
কদর বেড়েছে।
ভারত বিখ্যাত দুখুশ্যাম
চিত্রকর গ্রামের মহিলাদের তালিম দিচ্ছেন। ঐতিহ্যের সাথে সাথে নতুনের মেল বন্ধন
ঘটাতে আধুনিক প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করছেন। প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হচ্ছে যথাসম্ভব।
রঙের ঔজ্বল্য বাড়াতে ও টেকসই করতে ভেষজ রঙের বদলে কেমিক্যাল রঙ ও কাজে লাগাচ্ছেন। 
ভেষজ ও রাসায়নিক রঙ ব্যবহারে পটচিত্রের তারতম্য নীচে ছবিতে দেখা যায়। বাজার ধরতে পটের সাথে সাথে ব্যাগ, পোশাক, কাপ, ফুলদানিতেও আঁকছেন শিল্পীরা।
ভেষজ ও রাসায়নিক রঙ ব্যবহারে পটচিত্রের তারতম্য নীচে ছবিতে দেখা যায়। বাজার ধরতে পটের সাথে সাথে ব্যাগ, পোশাক, কাপ, ফুলদানিতেও আঁকছেন শিল্পীরা।
আজ অনেকটাই সুদিন ফিরেছে
পটুয়াদের। আধুনিক প্রজন্মও বেশ উৎসাহী। এই পেশায় ভবিষ্যৎ দেখছেন অনেকেই। শহরের বিভিন্ন
মেলা ও প্রদর্শণীতে জায়গা পাচ্ছেন তারা। সরকারী সাহায্যে ভারতের অন্যান্য শহর
এমনকি ইউরোপ ও আমেরিকাও পাড়ি দিচ্ছে পটচিত্র। ইদানীং নানা অ্যাওয়ার্ডও পাচ্ছেন
পটুয়ারা। এইডস রুখতে প্রচার, বাল্যবিবাহ, কন্যাভ্রূণ হত্যার মত নারকীয় প্রথা বিরোধী
প্রচারে ব্যবহার করা হচ্ছে পটুয়াদের।
পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা
থানার নায়া গ্রাম পটুয়াদের আঁতুড়ঘর। অধিকাংশ বাড়ির দেওয়ালেও নানান ছবির সমারোহ।
পটুয়ারা একটা কো-অপেরেটিভও তৈরি করেছেন, নাম "চিত্রতরু"। তারা প্রতি বছর
নভেম্বর মাসে "পট মায়া" নামে মেলার আয়োজন করেন। লোক-শিল্প প্রেমী মানুষ
ভিড় জমায় এই মেলায়। বিক্রিবাটার বাজারও মন্দ না। সময় পেলে ঘুরে আসুন, সত্যিই পটের
মায়াজাল বিছিয়েছে এই গ্রাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিশ্ব বাংলার নানা হাটে পটুয়াদের
স্থান দিয়েছেন। ইকোপার্ক কিংবা এয়ারপোর্টে বিশ্ব বাংলার হাটে পটুয়াদের স্টল দেখতে
পাবেন। আশা করবো ভবিষ্যতে আরও প্রসার ঘটবে বাংলার নিজস্ব এই শিল্পের।
প্রতিবেদন- কৌশিক মাইতি
 



 
 
 
Post a Comment