Header Ads

মাতৃভাষা আন্দলনের পথিকৃৎ, ছৌ নাচ, ঝুমুর গবেষক ও নৃতত্ববিদ ড. পশুপতি প্রসাদ মাহাতোর জীবনাবসান


জন্ম ও শিক্ষা:

ড. পশুপতি প্রসাদ মাহাতো ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ শে অক্টোবর পুরুলিয়ার ডাবর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্বে এম এ পাস করেন ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে। তিনি রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট, হাজারিবাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যরত্ন উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ঝাড়খন্ডরত্ন ও বঙ্গরত্ন উপাধিতেও ভূষিত হন। মধ্যপ্রদেশের সাগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভূবনেশ্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান পান তিনি। তিনি দলিতদের স্বাধিকারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি থেকে আম্বেদকর ফেলোশিপ পান। তিনি অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সিনিয়ার রিসার্চ ফেলো ছিলেন।


তিনি ফোকলোর অ্যাকাডেমি অফ ইন্ডিজেনাস পিপল ইন ইন্ডিয়া এবং সেন্টার ফর স্টাডি এন্ড রিসার্চ অন ইন্ডিজেনাস পিপল ইন ইন্ডিয়ার ফাউন্ডার ডাইরেক্টর ছিলেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি, অ্যানথ্রোপোলজি সাব কমিটি,ইনস্টিটিউট অফ হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজ কোলকাতার লাইফ মেম্বার ছিলেন। ড. পশুপতি প্রসাদ মাহাতোর লেখা নিবন্ধ নিত্যনৈমিত্যিক ভাবে দৈনিক স্টেটসম্যান, প্রতিদিন ইত্যাদি সংবাদপত্রে প্রকাশ পেত।

তিনি সাসেক্স ইউনিভার্সিটি, ন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি অফ অস্ট্রেলিয়া, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাড্রাস বিশ্ববিদ্যালয়, মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রিত হয়েছেন গেস্ট প্রফেসর হিসেবে।

ওনার ঠাকুরদাদু ও মায়ের বাবা সমগ্র মাহাতো সম্প্রদায়ের প্রথম মাধ্যমিক বা তৎকালীন মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

নির্বাকাইজেশেন তত্বের আবিষ্কার ও ডি-লিট লাভ:

প্রফেসার এম এন শ্রীনিবাসের সংস্কৃতাইজেশেন তত্বের পাশাপাশি আর একটি তত্ব তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন এই সব নির্বাকদের কথা তোমাদের বলিতে হইবেএই নির্বাক কথাটি ওনাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। যে সব কমিউনিটি নির্বাক, যাদের কথা কেউ বলতে চায়না, যারা কথা বলতে পারেনা ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদেরকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন সেই সব কমিউনিটির ভাষা প্রকাশের জন্য তিনি একটি বই লেখেন- ‘Sanskritaisation vs Nirbakization ’এই বইটির জন্য রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি ড. পশুপতি প্রসাদ মাহাতোকে ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িষ্যা, আসামের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে মাহাতো সম্প্রদায়কে নিয়ে গবেষণা করে তাদের কথা তুলে ধরেছেন এই বইতে।


এম এন শ্রীনিবাসের সংস্কৃতাইজেশন তত্বানুযায়ী অপেক্ষাকৃত নীচু জাতের মানুষরা উঁচু জাতের রীতি নীতি, আচার-আচরন, সংস্কৃতি, ভাষা অনুকরণ করতে থাকেন। এইভাবে অনুকরণ করতে করতে কখন যে তাঁরা নিজেদের সব রীতি নীতি হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন তা বুঝতেই পারেননা। এই নির্বাকদের কথা নিয়েই তিনি নির্বাকাইজেশন তত্বের অবতারণা করলেন।


তিনি মাহাতো সম্প্রদায় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন যে এদের জীবনের অনেক বর্ণনা ফুটে আছে ঝুমুর বা ঝুমৈর গানে। ১৮৭১ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত প্রায় ৯ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ জঙ্গলমহল থেকে আসাম ও উত্তরবঙ্গে চলে যান তাদের দুঃখ দুর্দশা খুঁজে পান ঝুমুর গানে। তিনি প্রধানত এই অভিবাসী মাহাত সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়েই গবেষণা করেন। উত্তরবঙ্গের চা বাগানে তিনি একটি ঝুমুর গান সংগ্রহ করেন যাতে তৎকালীন সময়ে চা বাগানে কাজ করার সময় নিপিড়িত হওয়ার কথা জানতে পারেন। গানটির কয়েকটি লাইন শুনলেই যা বোঝা যায়। গানটি হল- বলি চল মিনি আসাম যাব দেশে বড় দুখ রে, দেশে বড় দুখ। আসাম দেশে রে মিনি চা বাগান হরিয়াল। আসাম দেশে রে মিনি চা বাগান হরিয়াল। সর্দার বলে কাম কাম কাম, বাবু বলে ধরিয়ান, সাহেব বলে লিব পিঠের চাম রে যদুরাম। ফাঁকি দিয়ে পঠালি আসাম

কালি দাশগুপ্ত এবং সঙ্গীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কাছ থেকে তিনি এরকম আরো ঝুমুর গান শেখেন যেগুলি তাকে অত্যন্ত সাহায্য করে।

ছৌ নাচ নিয়ে ভুল প্রচারের প্রতিবাদ ও সঠিক তথ্যের প্রতিষ্ঠা:

তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ঝুমুর গান এবং ছৌ নাচ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। কলকাতার এক গবেষক যিনি প্রথম ছৌনাচ গবেষক বলে নাম ছড়িয়েছিলেন তিনি ছৌনাচকে নিয়ে অপমানজনক কথাবার্তা বলেন। তিনি বলেন- পুরুলিয়ার লোক অপেক্ষাকৃত কুৎসিত বলিয়া ছৌ নাচের সময় মুখোশ ব্যবহার করে। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও লিখে তিনি প্রচার করছিলেন- ‘To cover the ugly human features they use musk ’. এ কথার প্রতিবাদ করেন ড. পশুপতি প্রসাদ মাহাতো। তিনি এইজন্য একটি বইও লেখেন ‘Performing Arts of Jungle Mahal and Jharkhand’


ঝুমুর গান নিয়ে বিকৃতির প্রতিবাদ ও দূরদর্শনে ঝুমুর প্রচার:

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক ঝুমুর গান নিয়ে অপপ্রচার করে যার প্রতিবাদ করেন ড. পশুপতি প্রসাদ মাহাতো। যেমন এক ভদ্রলোক বলেন ঝুমচাষ থেকে ঝুমুরের উৎপত্তি। এসব বিকৃতিকে দূর করার চেষ্টা করেছেন তিনি বই, পত্র পত্রিকায় লিখে এবং দূরদর্শনে ঝুমুর গান গেয়ে। মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ময়ুরভঞ্জ হল ঝুমুর গানের দেশে সেখানে ঝুম চাষ কখনও হয়নি অথচ এরকম বিকৃতি শুনতে হয়েছে ঝুমুর গানকে। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখিও শুরু করেন। তিনি হলেন প্রথম শিল্পী যিনি দূরদর্শন এবং আকাশবাণিতে ঝুমুর গান গেয়েছিলেন। ঝুমুর গান গাওয়ার সময় দূরদর্শন কর্তৃপক্ষ মাদোলের ব্যবস্থা করেননি এতটাই ওনারাও অসচেতন ছিলেন। যে কারণে তিনি সম্প্রচার পিছিয়ে দিয়ে বলেন মাদোল ছাড়া ঝুমুর হয়না মাদোল ছাড়া ঝুমুর গাইবোনা। দূরদর্শন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হন মাদোলের ব্যবস্থা করতে। পরবর্তীকালে ঢোল, মাদোল, ধামসা নিয়ে স্বমহিমায় দূরদর্শনে ঝুমুর গানের পথ চলা শুরু হয়।



ঝুমুর গানের সংরক্ষণে উদ্যোগ:

তিনি প্রায় ২০০০ ঝুমুর গানকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে গেছেন। যা কুড়মালি ভাষার এক অন্যতম সম্পদ।


ভারতের আদিবাসী এবং দলিত সমাজ নিয়ে আন্দোলন ও গবেষণা:

ড. পশুপতি মাহাতোর মতে আদিবাসীদের সমাজ রীতি নীতি সংস্কৃতি এসব নিয়ে বহু মানুষ আজও জানেনা তাই তিনি এদের নিয়ে গবেষণা করেন। খাড়িয়া, লোধা, শবরদের থেকে কুড়মি মাহাত সম্প্রদায়কে উপজাতি সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত না করার চেষ্টার তিনি প্রতিবাদ করেন এবং ওনার আন্দোলনও সফল হয়। এ নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন-ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ



সুন্দরবনে আদিবাসীদের আগমন নিয়ে আলোকপাত:

সুন্দরবনের আদিবাসীদের আজও বলা হয় বুনো বা বুনা। নীল চাষ করার জন্য ছোটোনাগপুর মালভূমির আদিবাসীরা সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে যান। তাদের সেই অত্যাচারের কাহিনী নিয়েও তিনি লিখেছেন। এগুলি নিয়ে তিনি সংগ্রহ করেছেন অনেক ঝুমুর গান যেমন- নীল লোটা কাটে কাটে হাত গেল ফাঁটে বাবুর বাপ বাবুর বাপ যেন টুকু কাঁচা হলুদ বাঁটে

সুন্দরবনে এই আদিবাসীরা কিভাবে কোলাঘাট থেকে মাটি নিয়ে সুন্দরবনের মাটিকে উর্বর করেছিলেন সেসব কাহিনী জানতে পারা যায় ওনার লেখা বইতে। প্রায় ৮ লাখ ৭২ হাজার মানুষ এভাবে সুন্দরবনে গিয়েছিলেন এইসব মানুষদের ইতিহাস ঢাকা পড়ে গেছে বা তুলে ধরার চেষ্টা হয়নি যা তিনি তুলে ধরতে চেষ্টা করেন। এ নিয়ে তিনি লেখেন-সুন্দরবনে আদিবাসীর আগমন ও তাদের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

ওনার লেখা বইগুলির তালিকা-

১. SANSKRITAISATION VS NIRBAKAIZATION

২. ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ

৩. সুন্দরবনে আদিবাসীর আগমন ও তাদের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

৪. Performing Arts of Jungle Mahal and Jharkhand’

৫. জঙ্গলমহল- রাঢ়ভূম ও ঝাড়খন্ডের ভূমিব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও সংগ্রামী ইতিহাসের রূপকথা

৬.এক গুচ্ছ পাহাড়ি ফুল

৭. সৃষ্টি দৃষ্টি দৃষ্টিপথ

৮. মহাকবি বিনন্দিয়া সিংহের পদাবলী রামায়ন ও রাধা কৃষ্ণ

৯. জঙ্গলমহল ও ঝাড়খন্ডী লোকদর্শন


প্রায় তিন মাস ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। গতকাল তিনি আমাদের ছেড়ে পরলোক গমন করেছেন। মানভূম ও ঝুমুর, ছৌনাচ প্রেমীরা তাই শোকাহত। ওনার কাজগুলো বেঁচে থাকবে।

প্রতিবেদন- অমিত দে


তথ্যসূত্র:

বৃহস্পতি টিভি

http://www.calcuttayellowpages.com/adver/108750.html



No comments