Header Ads

সংগীত চর্চায় বাঙালি



সংগীত চর্চায় বাংলার অবদান বলতে শুরু করলে মনে হয় আমার জীবন কেটে যাবে পুরো তবু শেষ হবেনা। বাংলা সংগীতের কত দিক তা এক মানুষের পক্ষে গবেষণা করে শেষ করা অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান, নজরুল ইসলামের গান এবং লালন ফকিরের গান নিয়ে গবেষণাগার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশে দেশে।

বাউল, বিষ্ণুপুর ঘরানা, টপ্পা, ঠুমরী, ধ্রুপদ, খেয়াল, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, ধামাইল, গম্ভীরা, আখড়াই, শ্যামা সঙ্গীত, কবিগান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদী, দিজেন্দ্রগীতি, প্রভাত সঙ্গীত, লালনগীতি, ঝুমুর গান, ভাদু গান, টুসু গান, হাপু গান, কীর্তন, বাদী গীত, পাতা গীত, আগমনী গান, পাশা খেলার গান, বিচ্ছেদী গান, চারণ গান, পটুয়া সঙ্গীত, সারি গান, বোলান গান, ইসলামী সংগীত, ফুলের গান, জাওয়া গান ও হাজার রকমের লোকসঙ্গীত রয়েছে। এত রকমের গান আর কোন ভাষাতেই  নেই। ধর্ম বর্ণ সবে নির্বিশেষে বাংলার গান বাংলা ভাষাকে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট ভাষায় পরিণত করেছে।
                                              
 নাই বাইয়া যাও ভাটিয়ালী নাইয়া


 ভাটিয়ালী নদী দিয়া

আমার বন্ধুর খবর কইয়ো

আমি যাইতেছি মরিয়া।




এরকম ভাটিয়ালি গান কিংবা খাঁচার ভিতর অচীন পাখি, গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ, আবার আসিব ফিরে, আমি বাংলায় গান গাই, পরদেশী মেঘ এরকম কত যে গানের ধারা তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

বাংলা গান দুটো দেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও রবীন্দ্রনাথের গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা যা সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে গর্বের বিষয়।

২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করে। ভারতের আর কোন গানই এ মর্যাদা পায়নি যা বাঙালিকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপায় পৌছে দিয়েছে।

সূফীবাদ, বৈষ্ণবধর্ম, শ্রীচৈতন্য, ইসলাম দর্শন, মধ্যযুগীয় সাহিত্য, রামায়ন, মহাভারত, হিন্দু দর্শন সব কিছুই সময়ের সাথে সাথে মিলে মিশে বাংলা সাহিত্য  ও সঙ্গীতকে করে তুলেছে কালজয়ী।

ঠাট ও রাগের অত্যন্ত সুন্দর ব্যবহারে বাংলার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সারা পৃথিবীর সঙ্গীতকে হার মানায়। বিলাবল, ইমন, কল্যাণ, কাফি, খাম্বাজ, আশাবরী, বাঙ্গাল ভৈরব, পূর্বী এরকম রাগের সঠিক ব্যবহার বাংলা সঙ্গীতকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, বলরাম দাস প্রমুখ বৈষ্ণব পদকর্তাগণ রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেমচেতনার গান থেকে শুরু করে শাক্তভাবনার রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সূফী দর্শনে প্রভাবিত লালন ফকির, হাসান রাজা, শাহ আব্দুল করিম সকলে রেখে গেছেন অসাধারণ সংগীতের নিদর্শন।

বাংলার সংগীতকারদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২২৩০ টি, কাজী নজরুল ইসলাম চার হাজারের অধিক, প্রভাত রঞ্জন সরকার ৫০১৮ টি, লালন ফকির ১০,০০০ এর অধিক গান আবিষ্কার ও সুর দেওয়ার নজির রেখে গেছেন। দক্ষিন ভারতের আন্নামাচারীয়ার মতো কিছু গায়ক সংখ্যায় এগিয়ে থাকলেও গানের দর্শনের অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের আদান প্রদান বাংলার গানে অনেক নিত্য নতুন বৈশিষ্ট্য এনেছে বাংলা গানে চিরকালই।

পুরানো সময়ের মোটাজাগ, কানাই ধামালী, বীররসাত্মকের মতো গান কামরূপ, উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ছিল। প্রাক আধুনিক যুগে নৌকা বাওয়া, মাঝি, ঝড়, মানুষের সুখদুঃখ নিয়ে ভাটিয়ালি প্রচলিত হয় সুন্দরবন ও বাংলাদেশের নদী নালা যুক্ত অঞ্চলে।

১৭শ শতকে ফার্সি ভাষা ও ইসলাম দর্শনে প্রভাবিত জারি গানও বাংলা গানের এক অন্যতম রূপদর্শন রেখে গেছে।

রাঢ়বঙ্গে প্রধানত মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ধান ও কৃষিকেন্দ্রীক মানুষের বাদী গানও আগে প্রচলিত ছিল।রাঢ় অঞ্চলের কৃষকরা জমিতে ধান রোপন করার সময় কৃষিকাজের সাথে নারী ও পুরুষের যৌনতা প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটিয়ে বাদী গান বেঁধে দুইপক্ষ গানের সাথে সাংস্কৃতিক বাদ-বিবাদ করতেন।

তাছাড়া পুরুলিয়া ও সাঁওতাল পরগণা অঞ্চলের এক আনন্দগীত প্রচলিত ছিল যা সাধারণত পাতা গীত নামে পরিচিত ছিল।

উত্তরবঙ্গ, আসামের গোয়ালপাড়া, বাংলাদেশের অঞ্চলে পরিবার, মানুষের কর্মজীবন, গোরুর গাড়ি বাওয়া এসব নিয়ে প্রচলিত ছিল ভাওয়াইল।

যেমন একটা গানের উদাহরণ দিলেই বোঝা যায় ভাওয়াইয়ার বৈশিষ্ট্য।



ওকি গাড়িয়াল ভাই,

কত রব আমি পন্থের দিকে চাঞা রে।

যেদিন গাড়িয়া উজান যায়।



গ্রামাঞ্চলে ভাদুপূজাকে কেন্দ্র করে ভাদু গান, টুসু গান কার্তিক পূজাকে কেন্দ্র করে এক ধরনের গান। ধান ওঠার সময় নবান্ন উৎসবের গান।

পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া,মেদিনীপুর, ঝাড়খন্ডের সাঁওতাল পরগণা,সিংভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, গিরিডি, ধানবাদ, বোকারো, পালামৌ জেলা, ওড়িষ্যার সম্বলপুর, কেওনঝড়, সুন্দরগড়, ময়ূরভঞ্জ জেলা পর্যন্ত অংশের ঝুমুর গান প্রচলিত ছিল।

নজরুল গীতি, রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া রজনীকান্ত সেন, রামনিধি গুপ্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলালের গানও দুই বাংলায় আজও যথেষ্ট প্রভাবিত করে মানুষকে।


রবীন্দ্র পরবর্তীতে সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, মান্না দে, শচীন দেব বর্মন, রাহুল দেব বর্মন, শ্যামল মিত্র, রুনা লায়লা সকলেই গানের নতুন নতুন দিক উন্মোচন করেছেন। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, ভবানীচরণ দাস, রাধারাণী দেবী ও গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা ভক্তিগীতি এবং আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও নির্মলেন্দু চৌধুরী বাংলা লোকসঙ্গীতের কয়েকটি অবিস্মরণীয় নাম।

বর্তমানে বাংলা ব্যান্ড, আধুনিক গান কোন কিছুতেই বাংলা গান পিছিয়ে নেই। ব্যান্ডের মধ্যে মহীনের ঘোড়াগুলি, ফসিলস্, চন্দ্রবিন্দু, ভূমি, ক্যাকটাস, পৃথিবী, ফকিরার মতো অসংখ্য ব্যান্ডের গানও নতুনত্ব উন্মোচন করে। সুতরাং এটা বলা যায় বাংলার পল্লীগান, যাত্রাপালা, কীর্তন, বাউল সব বাঙালির সাথে জুড়ে আছে। বাঙলার সংগীতচর্চার নিত্য নতুন ধারা কখনও থেমে থাকেনি ভবিষ্যতেও এই ধারা বর্তমান থাকবে এটা আমরা আশা করতেই পারি।
                                                          লেখায়-অমিত দে



No comments