Header Ads

নন্টে-ফন্টে ও বাঁটুলদের একলা ফেলে চলে গেলেন বাংলা কমিক্সের কিংবদন্তি শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ


বাংলা কমিক্স জগতে একটা যুগের অবসান। চলে গেলেন বাংলা কমিক্সের প্রবাদপ্রতিম স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ। আজ সকাল দশটা বেজে পনেরো মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। গত ২৫ দিন ধরে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিক অসুস্থতার জন্য প্রয়াত হলেন তিনি৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। এতদিনের চেষ্টা, অনুরাগীদের প্রার্থনা সমস্ত কিছুকেই ব্যর্থ করে বাঙালি সমাজকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন তিনি। 


এইতো কদিন আগেই শরশয্যায় শুয়ে পদ্মশ্রী পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি। ৯৮ বছরের শিল্পীকে রক্ত দিতে হচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি শ্বাসপ্রশ্বাসেও বেশ সমস্যা ছিল তাঁর। আগেই রাজ্য সরকার নারায়ণ দেবনাথের চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছিল। গত ২৪ শে ডিসেম্বর হাওড়ার শিবপুরের বাড়ি থেকে কলকাতার নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয় তাঁকে। চিকিৎসকদের একটি বিশেষ দল তৈরি করে শিল্পীর চিকিৎসা করা হচ্ছিল। তবে পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না হওয়ায় বেলভিউ হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে রাখা হয় তাঁকে। 

নারায়ণ দেবনাথ বাংলার এক কিংবদন্তি কমিক্স শিল্পী। যিনি আমাদের শৈশবকে নানান কমিকসের ভিড়ে ভরিয়ে দেন। 'নন্টে-ফন্টে', 'হাঁদা ভোঁদা', 'বাঁটুল দি গ্রেটে'র মতো অসাধারণ সৃষ্টি প্রায় সব বাঙালির পছন্দ। তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের সবার প্রিয় ব্যক্তি নারায়ণ দেবনাথ। এক বছর আগেই 'বাঁটুল দি গ্রেট', 'হাঁদা ভোঁদা' ও 'নন্টে-ফন্টে' অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করে। 

নারায়ণ দেবনাথের ছেলেবেলার আইকন ছিলেন হলিউড সিনেমার 'টারজান।' তিনি ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন বড়ো হয়ে একজন বডিবিল্ডার কিংবা গায়ক হবেন। যদিও ১৯৪০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টসে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি বেছে নেন বাণিজ্যিক গ্রন্থ অলংকরণ শিল্পীর জীবিকা। তাঁর প্রথম কমিকস আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বিমল ঘোষের কাহিনী অবলম্বনে রবীন্দ্রজীবনী 'রবি ছবি'। এরপর তিনি একে একে নিয়ে আসেন 'হাঁদা ভোঁদা', 'বাঁটুল দি গ্রেট', 'শুঁটকি আর মুটকি', 'পটলচাঁদ, 'নন্টে-ফন্টে', 'কৌশিক রায়', 'বাহাদূর বেড়াল', 'ডানপিটে খাঁদু', 'কেমিক্যাল দাদু', 'বটুকলাল' এর মতো জনপ্রিয় কমিকস্ চরিত্র।  

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর লেখা ও আঁকা কমিক্স সব বয়সের বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছে। কমিক স্ট্রিপ ছাড়াও তিনি শিশু-কিশোরদের উপন্যাসও অলঙ্করণ করেছেন। বিশ্বের দীর্ঘতম কমিক স্ট্রিপ হিসেবে তাঁর 'হাঁদা ভোঁদা' বিশ্বরেকর্ড করেছিল। 

বাংলা কমিক্সের জগতে নারায়ণ দেবনাথের আগমন ঘটে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদকমণ্ডলীর উৎসাহে। তাঁর প্রথম কমিকস 'হাঁদা ভোঁদা' নামটিও তাদের প্রস্তাবিত। সে সময় বাংলা কমিকস্ বলতে ছিল এক মাত্র প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ীর আঁকা শেয়াল পন্ডিত, যা তখন যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হত। 'হাঁদা ভোঁদা' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকদের সমাদর পায় এবং শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুরুতে নারায়ণ দেবনাথ নিজেই 'হাঁদা ভোঁদা'য় অঙ্কন ও কালি বসানোর কাজ করতেন। পরবর্তীকালে তা গ্রেস্কেলে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়।  
 
তিনি 'হাঁদা ভোঁদা' যখন শুরু করেছিলেন তখন বাংলা ভাষায় কমিকসের আবেদন প্রায় ছিল না বললেই চলে। অনেকটা একা হাতেই একটি জয়যাত্রার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি, যা অব্যাহত থাকে তাঁর পরের প্রতিটি সৃষ্টিতেই। বিশেষত 'বাঁটুল দি গ্রেট'-এর মাধ্যমে বাঙালি শিশুদের মাঝে কমিকপ্রীতির অভূতপূর্ব  জোয়ার আসে। 

সাহিত্যঙ্গনে তিনি তাঁর অবদানের স্বরূপ বহু স্বীকৃতি পেয়েছেন। একে একে তিনি অর্জন করেছেন 'সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার', 'বিদ্যাসাগর পুরস্কার' আর পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় সম্মান 'বঙ্গবিভূষণ'। একমাত্র ভারতীয় কার্টুনিস্ট হিসেবে তিনি ডি.লিটও অর্জন করেছেন। শিল্পজগতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তাঁকে ভূষিত করা হয় পদ্মশ্রী সম্মানে। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments