Header Ads

রবীন্দ্রনাথ, দেশভাগ ও গোয়ালন্দ চিকেন কারি


নদীর ঘাটে যুগ যুগ ধরে প্লাবিতা হয় ইতিহাস। নদী ভাঙনের মতোই ঘাটের ইতিহাসে জড়িয়ে যায় ভাঙাগড়ার ইতিবৃত্তে। যুগান্ত, যা সময়ের পট কথা ভেসে চলে মানুষের মুখে মুখে। দেশ ভাগ, বাস্তবে যা বাংলা ভাগ। যে ভাগ চেনা নদী ঘাটকে পরিণত করেছে জলসীমায়। প্রতিবেশীকে পরিণত করেছে পররাষ্ট্রের নাগরিকে।সম্পর্কের আগে যুক্ত করেছে 'কূটনৈতিক' শব্দটিকে।গোয়ালন্দ ঘাট এমন একটি নদী বন্দর, যা এই ভাঙনের সাক্ষ্য বহন করে নীরবে। যে নদী ঘাটের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে  জড়িয়ে আছে ঢাকা, কলকাতা, আসামের মানুষজনের স্মৃতি। পদ্মার প্রগাড় আকাশ নীল জল চিরে এই ঘাট থেকেই এক সময় স্টিমার ভাসতো কলকাতার উদ্দেশ্যে। 


অন্যদিকে কলকাতা থেকে ফিরতি পথের যাত্রীরাও জড়ো হতেন এই গোয়ালন্দ ঘাটে। আজ সে ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ভিড়ে ম্লান একটি রেল স্টেশন। 

যাত্রীদের সোরগোল, স্টিমারের যাওয়াআসা সব মিলিয়ে সেই সময় প্রতিদিন জনসাধারণের কোলাহলে নতুন নতুন গল্প লিখত এই নদী ঘাট। সেই গল্পে ছিল বৈচিত্র্য, সেই গল্পে ছিল আদান প্রদান, ভালবাসা। ভারতীয় উপমহাদেশ, এই মাটির সঙ্গে মিলেমিশে বেড়ে উঠেছে বৈচিত্র্য। যে বৈচিত্র্য লালন করেছে ভূমিজ সমাজ। নদীর ঘাট সেই বৈচিত্র্যর ইতিহাসই বহন করে। যে ইতিহাসকে বারে বারে ছুঁয়ে যায় সাহিত্য। বঙ্কিম চন্দ্রের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাস ও রবীন্দ্রনাথের 'দেবতার গ্রাস' কবিতায় সেকালের গঙ্গাসাগর তীর্থযাত্রার যে বিপদসংকুল ছবি আঁকা হয়েছে, তাও এক সময় ছুঁয়ে যেতো এই গোয়ালন্দ ঘাটকে। 

ঘাটের বিভিন্ন গল্পের সাথে জড়িয়ে গেছে একটি রান্নার ইতিবৃত্ত। সারেংদের হাতের এই রান্না তৃপ্ত করত ক্ষুদার্থ যাত্রীদের। কবি নিজেও এই পথে স্টিমার যাত্রা করেছিলেন বলে জানা যায়।আরও জানা যায় তার পছন্দের ছিল সারেঙদের রান্না করা এই পদ, যার নাম গোয়ালন্দ চিকেন কারি বা স্টিমার কারি।

রেল পূর্ব সময়কালে বাংলার যোগাযোগের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম ছিল নদীপথ। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য  কেন্দ্র ছিল কলকাতা। বাংলার নদীগুলো এমনভাবে শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত ছিল নাগরিকরা সহজেই নদীপথে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারতো। এই কারণে এই অঞ্চল আরও বেশি বাণিজ্য সহায়ক হয়ে উঠেছিল।

অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার মানুষদের এপার বাংলায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু শহর কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল গোয়ালন্দ ঘাট। পরে চালু হয় রেল। রেল চালু হলেও সেই রেল যাত্রীদেরও ছুঁয়ে যেতে হতো গোয়ালন্দ ফেরি ঘাট। এখানেই জন্ম গোয়ালন্দ চিকেন কারির। যা যুগান্ত পেরিয়ে আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় খোঁজ করলেই মেলে তার বিভিন্ন রেসিপির সন্ধান।

স্টিমার চালুর আগে নৌকা যাত্রা ছিল দীর্ঘ। স্টিমার চালু হবার পর সেই সময় কিছুটা কমে আসে। যে নদী পথে প্রায় এক মাস সময় লাগতো নৌকায়। স্টিমার চালু হওয়ায় সেই কমে দাঁড়ায় ১৫ ঘণ্টায়। দ্রুত গতির স্টিমার আসলে সেই পথ কমে হয় ছয় ঘণ্টায়। তবুও কম সময় নয়।এই দীর্ঘ যাত্রা পথে খাওয়াদাওয়ার দরকার হতোই। ভরসা তখন স্টিমারের সারেঙরাই। তারাই রান্না করতো ঘাট থেকে নিয়ে যাওয়া মুরগির মাংস আর ভাত। সেই রান্নার স্বাদ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে পড়ে যাত্রীদের মধ্যে। ঘাটের পাশেও তৈরি হয় বেশ কিছু খাবার দোকান। সেখানেও পরিবেশন করা হতো প্রায় একই স্বাদের মুরগির মাংস আর ভাত। এই কষা মাংসই গোয়ালন্দ কারি নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

সৈয়দ মুজতবা আলীর 'নোনাজল' গল্পে গোয়ালন্দ চিকেন কারি বা স্টিমার কারি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, "এ-জাহাজের ও-জাহাজের ডেকে-কেবিনে কিছু কিছু ফেরফার সব সময়ই ছিল, এখনও আছে, কিন্তু সব কটা জাহাজের গন্ধটি হুবহু একই। কীরকম ভেজা-ভেজা, সোঁদা-সোঁদা যে গন্ধটা আর সব-কিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেটা মুরগি কারি রান্নার৷ আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, সমস্ত জাহাজটাই যেন একটা আস্ত মুরগি, তার পেটের ভেতর থেকে যেন তারই কারি রান্না আরম্ভ হয়েছে।"

যদিও আজ গোয়ালন্দ একটি সাধারণ স্টেশন। কিন্তু তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, অতীত চারণ, দেশ ভাগের যন্ত্রণা। তবে গোয়ালন্দ ঘাটের রসনার স্বাদটুকু কিন্তু বাঙালির জীবনে স্থায়ী হয়ে গেছে তার রান্না ঘরে প্রবেশ করে। ইতিহাস গোয়ালন্দ কারির বা গোয়ালন্দ ঘাটের মুরগির মাংসের রন্ধন পদ্ধতি। তবে গোয়ালন্দ স্টিমার ফাউল কারীর রেসিপি কি তা নিয়ে প্রচুর মতানৈক্য আছে। অনেকেই মনে করেন, এটি চিকেন কান্ট্রি কারীরই নামান্তর। কেউ কেউ বলেন এটি ডাকবাংলো চিকেন এরই আরেক রূপ। তবে এক জায়গায় সবাই একমত, এই রান্নার বিশেষ গন্ধ। সম্ভবত এর কারণ এই রান্নার সঙ্গে মেশে চিংড়ি বাটা। 

কখনো চিংড়ি শুটকি। অনেকের মতে নোনা জলে হওয়া রান্নায় নতুন একটি গন্ধ যুক্ত করত। যা রান্না ঘরে বানানো রান্নায় অসম্ভব। উনবিংশ শতকে এই গোয়ালন্দ ঘাট থেকেই স্টিমার যেত, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, বর্মা তেও। একদিকে ক্লান্ত শরীর অন্যদিকে কম সময়ে রান্না করতে হবে। অতএব পেঁয়াজ, আদা, রসুন হামানদিস্তায় ছেঁচে নিয়ে, চিংড়ি বা শুঁটকি চিংড়ি ও তার সাথে গুঁড়িয়ে নিয়ে, সব একসাথে ভালো করে মেখে তারপর রান্না করা হতো।

ভারতীয় উপমহাদেশের রান্নায় চিংড়ি বাটা খুব একটা প্রচলিত নয়। মনে করা হয় মায়ানমার এবং তার লাগোয়া প্রতিবেশী দেশের রান্না থেকে চিংড়ি বাটার পদ্ধতি এই রান্নায় মিশেছিল। সঙ্গে ছিল লঙ্কা, পেয়াজ, রসুন, আদার সঙ্গে নুন, হলুদ, সর্ষের তেলের মতো সাধারণ মশলার ব্যবহার। মাংসের সঙ্গে ছোট আলুর টুকরো ছিল আবশ্যিক। একবার নিজেদের হেঁসেলে চেষ্টা করে দেখতেই পারেন ঐতিহাসিক গোয়ালন্দ চিকেন কারি। তবে পরিবেশনের আগে অতিথি অভ্যাগতদের অবশ্যই রান্নার ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করবেন। 

প্রতিবেদন- অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়


No comments