বনগাঁর বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজোতে দেবী দুর্গা পূজিত হন 'বেড়ালহাতি দুর্গা' রূপে
থিমের পুজোতে অনেক বেশি বাড়তি আকর্ষণ থাকলেও বনেদি বাড়ির পুজোতেও নানান আকর্ষণ থাকে। বনেদি বাড়ির পুজো বাংলার এক প্রাচীন ঐতিহ্য। বনেদি বাড়ির পুজোতে বারংবার বজায় থাকে বাঙালিয়ানা। বহু সভ্রান্ত পরিবারের মানুষ আজও মেতে ওঠেন বনেদিবাড়ির পুজোতে। অনেক বনেদি বাড়ির পুজো নানান ইতিহাসেরও সাক্ষ্য বহন করে। ঠিক এমনই একটি বনেদি বাড়ির পুজো হলো বনগাঁর বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজো।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজোর এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই পুজো রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো নামেই বেশি পরিচিত। পুজোর বয়স সাড়ে তিনশো বছর পেরিয়ে গিয়েছে৷ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠাকুরদা গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে আনুমানিক ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে সূচনা হয় বনগাঁর বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজো। কথিত আছে, গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায়কে নাকি দেবী দুর্গা স্বপ্নাদেশ দেখিয়ে তাঁর একটি বিশেষ রূপের পুজো করতে বলেন। সেইমতো এখানকার দুর্গাপুজোর পথচলা আরম্ভ হয়।
বনগাঁর বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজোতে অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। দেবী দুর্গা এখানে পূজিত হন 'বেড়ালহাতি দুর্গা' রূপে। প্রতিমার রূপ সাধারণ প্রতিমার মতোই হয়ে থাকে। পার্থক্য কেবল অন্য জায়গায়, সাধারণ প্রতিমার মতো দু'টি হাত থাকলেও অবশিষ্ট আটটি হাত বেড়ালের পায়ের মতো ছোটো হয়ে থাকে।
মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ দ্বিতীয়ার দিন, প্রতিপদে চণ্ডীর ঘট বসানো হয়। পুজোর দিনগুলিতেও সমান তালে চলে চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীতে বাড়িতে থাকা জোড়া শিব মন্দিরের নীচে বেলতলাতে হয়ে থাকে দেবীর বোধন। পুজোর বিসর্জনের আগে বাড়ির পুরুষরা দেবীকে বরণ করেন, তারপর বাড়ির মহিলারা দেবীকে বরণ করেন। প্রতি বছর নিয়ম মেনে দশমীর দিন আকাশে একটি সন্ধ্যাতারা উঠলেই বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির প্রতিমা নাওডাঙা নদীতে ভাসানো হয়। প্রতিমার ভাসান দেখতে নাওডাঙা নদীর ঘাটে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে কাটলেও জীবনের একটা বড় সময় ছয়ঘরিয়ার বাড়িতেই তিনি কাটিয়েছেন।সাড়ে তিনশো বছরের প্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজো তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে বহু বছর। অষ্টমীর দিন তিনি থাকতেন পুজোর মধ্যমণি হয়ে। দরিদ্র মানুষের মধ্যে নিজ হাতে তিনি বস্ত্র বিতরণ করতেন।
পুরানো প্রথা মতো জন্মাষ্টমীর দিন আমকাঠের কাঠামোতে প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয়। পরম্পরা অনুযায়ী প্রথম দিন বেলবরণ পুজোর ঠাকুরবাড়িতে ঘট বসিয়ে দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অষ্টমীর দিন যাঁরাই ঠাকুর দেখতে যান তাদের সকলকে প্রসাদ খাওয়ানো হয়। অতীতে সপ্তমী থেকে নবমী, এই তিনদিন পাঠাবলি দেওয়া হলেও সে সব পাট চুকে গেছে। অতীতে ছয়ঘরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বহু গ্রামের মানুষের পুজোর দিনগুলোতে ঠিকানা ছিল এই বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি। পূর্বে কয়েক হাজার গ্রামবাসীকে পুজোর দিনগুলোতে খাওয়ানো হত, যদিও সেই পরম্পরা আজও বিদ্যমান।
বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির সদস্যরা বর্তমানে কলকাতা নিবাসী৷ ছয়ঘরিয়ার বাড়িতে থাকেন কেবল সপ্তম পুরুষ চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী শোভা বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়সের চাপে তাঁরা দু'জনই চলার শক্তি হারিয়েছেন৷ বাইরে কারও সঙ্গে তাঁরা দেখা করেন না। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে অবশ্য রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো নিয়ে আজও উচ্ছাস আছে।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment