ভারতের বাদ্যযন্ত্র ব্যবসার পথিকৃৎ ছিলেন দ্বারকানাথ ঘোষ
"সঙ্গীতযন্ত্র কিনিতে হইলে ডোয়ার্কিনেরই কিনিবেন। উইাই আপনাকে যথার্থ সন্তোষ দিতে পারিবে।" এই বিজ্ঞাপনটির কথা নিশ্চয় মনে আছে সবার। কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটের বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্রের দোকান ছিল 'ডোয়ার্কিন এন্ড সন' এ খদ্দেরদের আকৃষ্ট করা হতো এই ধরণের বিজ্ঞাপনে। যে দোকানের এককালে বেশ সুনাম ছিল। ব্যবসায়ী দ্বারকানাথ ঘোষের হাত ধরে এই দোকানের মাধ্যমে ভারতের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি বাদ্যযন্ত্র ব্যবসা শুরু করেন, তাই দ্বারকানাথ ঘোষকে ভারতের বাদ্যযন্ত্র ব্যবসার পথিকৃৎ বলা হয়।
১৮৪৭ সালে তৎকালীন চব্বিশ পরগণার শুকদেবপুরে জন্মগ্রহণ করেন দ্বারকানাথ ঘোষ। অল্পবয়সে তিনি পিতৃহীন হলে কলকাতায় চলে আসেন। সুযোগের অভাবে তিনি খুব বেশিদূর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। আনুমানিক ১৮৬৫ সালে হ্যারল্ড কোম্পানিতে তিনি মাসিক ১০ টাকা বেতনে যোগ দিয়ে সততা ও কর্মকুশলতায় বড়সাহেবের প্রিয়পাত্র হন এবং তারই পরামর্শে বিলেত থেকে ধারে বাদ্যযন্ত্র আনিয়ে তাই দিয়ে তিনি এখানে বাদ্যযন্ত্র ও হারমোনিয়াম তৈরির কারখানা খোলেন। ক্রমে 'মিউজিক অ্যাডভাইসরি প্রেস' নামে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন।
১৮৭৫ সালে বৌবাজার স্ট্রিটে তিনি নিজ উদ্যোগে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন। বিদেশি কোম্পানি টমাস ডোয়ার্কিন্স-এর কাছ থেকে তিনি প্যাডেল হারমোনিয়াম ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র এনে বিক্রি করতেন৷ তাঁর কোম্পানির নাম প্রথমে ছিল ঘোষ এন্ড কোম্পানি। পরবর্তীকালে বিশিষ্ট সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কথামতো দ্বারকানাথ ঘোষ কোম্পানির নাম রেখেছিলেন 'ডোয়ার্কিন এন্ড সন'। সাহেবি নামের প্রতি দেশী লোকেদের একটা মোহ আছে, বিক্রি হবে ভালো এই কথাটা মাথায় রেখেই দোকানের নতুন নামকরণ করা হয় 'ডোয়ার্কিন এন্ড সন'।
বিলিতি দোকানের থেকেও সস্তা দামে তিনি বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করতেন। তাঁর ডালহৌসী স্কোয়ারের দোকানে ইংরেজি স্বরলিপি, পিয়ানো, আমেরিকান অরগ্যান, ইউরোপীয় ক্যারিওনেট প্রভৃতি মূল্যবান বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যেত। ঠাকুরবাড়ির প্রতিভা দেবী সঙ্গীতশিক্ষার স্কুল খুললে তাঁর অনুরোধে এসরাজ, সেতার, তানপুরা প্রভৃতি দেশী বাদ্যযন্ত্রও তৈরি করতে শুরু করেন তিনি।
১৮৮৪ সালে দ্বারকানাথ ঘোষ প্যাডেল হারমোনিয়াম সংস্কার করে এ যুগের বক্স হারমোনিয়াম তৈরি করেন। সেকেলে আমাদের দেশে লোকেরা খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা সব কিছুই করতো হাঁটু মুড়ে বসে। চেয়ারে বসার চল তেমন ছিলনা। সুতরাং পায়ের প্যাডেলের বদলে হাতে বেলো টিপে হারমোনিয়াম বাজাতে পারলে যে সুবিধা হবে সেটা উনি বুঝতে পেরেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের দেশে লঘু সঙ্গীতের জগতে বক্স হারমোনিয়ামের স্থান পাকাও হয়ে যায়।
দ্বারকানাথ ঘোষের কন্যা কুমুদিনী বিশ্বাস ও তাঁর ভাগ্নে জ্ঞানেন্দ্রমোহন সঙ্গীত জগতের দিকপাল ছিলেন। তাঁর নাতি পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ, পদ্মভূষণ ছিলেন একজন দূর্দান্ত তবলাবাদক। তিনি ভারতের বেশিরভাগ উচ্চমানের সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছেন।
প্রতিবেদন- সুমিত দে
Post a Comment